Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানি কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়?

ভূমিকা

অটো ফন বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সমকালীন ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। আট বছর (১৮৬২-১৮৭০ খ্রিঃ) প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং কুড়ি বছর (১৮৭০-১৮৯০ খ্রিঃ) ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তাতে জার্মানিসহ ইউরোপীয় রাজনীতি এক স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছিল। কূটনীতির জাদুকর বিসমার্ক ইউরোপীয় রাজনীতিতে জার্মানিকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করে তোলেন।

আদর্শ ও নীতি

বিসমার্কের নীতি ও আদর্শগুলি ছিল—(১) প্রাশিয়ার রাজতন্ত্রের পরিচালনাধীনে সমগ্র জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধরূপে গড়ে তোলা। (২) গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বারা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রই সকল সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ। (৩) সামরিক শক্তির মাধ্যমেই জার্মানির ঐক্যপ্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রাশিয়ার আইনসভায় ঘোষণা করেন—বক্তৃতা বা ভোটের দ্বারা নয়, ‘রক্ত ও লৌহ’ নীতির মাধ্যমেই জটিল সমস্যাগুলির সমাধান হবে।

যুদ্ধ ঘোষণা

জার্মানির ঐক্য গড়ে তোলার জন্য বিসমার্ক তিনটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই তিনটি যুদ্ধ ছিল—

(১) ডেনমার্কে সঙ্গে যুদ্ধ (১৮৬৪ খ্রিঃ)

শ্লেজউইগ ও হলস্টেন প্রদেশ নিয়ে ডেনমার্কের সঙ্গে বিরোধকে বিসমার্ক জার্মান ঐক্যস্থাপনের কাজে ব্যবহার করেন। প্রদেশ দুটি প্রাশিয়ার উত্তরে তথা ডেনমার্কের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। আইনত অঞ্চল দুটি ছিল ডেনমার্কের রাজনৈতিক প্রভুত্বের অধীন। ১৮৬৩ সালে ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিকের মৃত্যু হলে তাঁর দূর আত্মীয় নবম খ্রিস্টিয়ান রাজা হন। কিন্তু বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে অঞ্চল দুটির ওপর খ্রিস্টিয়ানের অধিকার অগ্রাহ্য করে। ডেনমার্ক এর বিরোধিতা করলে বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে দলে টেনে এনে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ডুপেলের যুদ্ধে (১৮৬৪ খ্রিঃ) পরাজিত হয়ে ডেনমার্ক প্রদেশ দুটির ওপর সমস্ত দাবি পরিত্যাগ করেন। কিন্তু, প্রদেশ দুটির বণ্টন নিয়ে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত গ্যাস্টিনের চুক্তি (১৮৬৫ খ্রিঃ) দ্বারা এই বিরোধের… সাময়িক মীমাংসা ঘটে। শ্লেজউইগ প্রাশিয়ার এবং হলস্টেন অস্ট্রিয়ার অধীনে যায়।

(২) অস্ট্রো-প্ৰাশিয়া যুদ্ধ

শ্লেজউহগ ও হলস্টেন এই প্রদেশে দুটির শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিরোধ বাঁধে। বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ সামরিক ও কূটনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেন। তিনি মনে করতেন জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র প্রাশিয়ার। তিনি ইতালিকে ভেনিস দানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বপক্ষে টেনে আনেন এবং বিয়ারিজ (Biarritz) নামক স্থানে সাক্ষাৎ করে (১৮৬৫ খ্রিঃ, অক্টোবর) ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নকে বেলজিয়াম প্রদানের কথা দিয়ে ফ্রান্সকে নিরপেক্ষ রাখেন। পোল্যান্ডের বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সমর্থন করে বিসমার্ক ইতিমধ্যেই জারের আস্থাবাজন হয়েছিলেন। অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্বে ইংল্যান্ড হস্তক্ষেপ করবে না এ ব্যাপারেও তিনি ইংল্যান্ডের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। এরপর সুচতুর বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাস্টিনের চুক্তি ভাঙার অজুহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, যা স্যাডোয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্যাডোয়ার যুদ্ধে (১৮৬৬ খ্রিঃ) অস্ট্রিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে প্রাগের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় এবং জার্মান রাষ্ট্রসংঘ ত্যাগ করে। ধূর্ত বিসমার্ক ভবিষ্যতে সাহায্যের আশায় পরাজিত অস্ট্রিয়ার ওপর কোনো শক্তি প্রয়োগ করেননি। এইভাবে উত্তর জার্মানি মুক্ত হওয়ায় ঐক্যের পথে জার্মানি অনেকটা এগিয়ে যায়।

(৩) ফ্রান্স প্রাশিয়া যুদ্ধ

(ক) প্রেক্ষাপট

তৃতীয় যে যুদ্ধটির দ্বারা বিসমার্ক জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন করেন সেটি হল ফ্রান্স প্রাশিয়া যুদ্ধ। অস্ট্রিয়ার পর জার্মানির ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক ছিল ফ্রান্স। দক্ষিণ জার্মানির ক্যাথোলিক রাষ্ট্রগুলি ফ্রান্সকে তাদের পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করত। ফলে উত্তর জার্মানি প্রাশিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হলেও দক্ষিণের পৃথক অস্তিত্ব তখনও বজায় ছিল। কাজেই জার্মানির ঐক্যের জন্য ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। এই পরিস্থিতিতে স্পেনের সিংহাসানের উত্তরাধিকার নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রাশিয়ার বিরোধ শুরু হয়। এর কারণ হল—প্রাশিয়া ও স্পেনের সিংহাসন একই হোহেনজোলার্ন রাজবংশের অধীনে এলে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকে ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও ইউরোপের শক্তিসাম্য বিঘ্নিত হবে বলে ফ্রান্স মনে করতে থাকে। তাই স্পেনের সিংহাসনে হোহেনজোলার্ন রাজবংশের কোনো উত্তরাধিকারী যাতে না বসতে পারেন তার জন্য ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন কাউন্ট বেনিদিতি নামে এক দূতকে এস শহরে বিশ্রামরত প্রাশিয়ার সম্রাট প্রথম উইলিয়মের কাছে পাঠান।

(খ) এম্স টেলিগ্রাম

বেনিদিতি প্রথম উইলিয়মের কাছ থেকে—প্রাশিয়ার রাজবংশের কেউ কোনোদিনও স্পেনের সিংহাসনে বসবেন না, এরূপ একটি স্বীকৃতিপত্র স্বাক্ষর করাতে চাইলে প্রাশিয়ার সম্রাট তাতে অস্বীকৃত হন এবং এই ঘটনার কথা তিনি তারযোগে বিসমার্ককে জানান (১৩ জুলাই, ১৮৭০ খ্রিঃ)। এই তার ‘এম্স টেলিগ্রাম’ নামে খ্যাত বিসমার্ক মূল টেলিগ্রামের কতকগুলি শব্দ বাদ দিয়ে পরদিন পত্রিকাতে ঘটনাটি প্রকাশ করেন। এর ফলে টেলিগ্রামের অর্থ সম্পূর্ণ পালটে গিয়ে এই দাঁড়ায় যে, প্রাশিয়ার সম্রাট ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে ফরাসিদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে ফ্রান্সে তীব্র জনমত সৃষ্টি হয়।

(গ) সেডানের যুদ্ধ

এস টেলিগ্রামের সূত্র ধরে পরদিনই ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সূচনা ঘটে সেডানের যুদ্ধের। বিসমার্ক কটাক্ষ করে বলেন—লাল কাপড় দেখে ফরাসি ষাঁড় ক্ষেপে গেছে (‘Bismarck showed the red rag Gallic (France) bull’)। যুদ্ধে ফরাসি সেনা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় (১৮৭০ খ্রিঃ, সেপ্টেম্বর)। সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন বন্দি হন। দ্বিতীয় ফরাসি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তিয়েরের নেতৃত্বে তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্স বিসমার্কের সঙ্গে ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি (১৮৭১ খ্রিঃ, ১০ মে)-তে আবদ্ধ হয়। সন্ধির শর্তানুসারে স্থির হয় – (১) ফ্রান্স, প্রাশিয়াকে আলসাস-লোরেন প্রদেশ দুটি ছেড়ে দেবে। (২) পাঁচ বিলিয়ন ফ্রা ক্ষতিপূরণ দেবে। যতদিন না ক্ষতিপূরণ পরিশোধ হবে, ততদিন জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সে মোতায়েন থাকবে। (৩) দক্ষিণ জার্মানির ব্যাভেরিয়া, ওয়ারটেমবার্গ, বেডেন ইত্যাদি অঞ্চল প্রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জার্মান রাইনের সীমান্ত দক্ষিণে ইন (Inn) নদী পর্যন্ত প্রসারিত হবে। সেডানের যুদ্ধের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক কেটেলবি বলেছেন—ফ্রান্স-প্রাশিয়া যুদ্ধজয়ের ফলে বিসমার্ক জার্মানির প্রভুত্ব ও জার্মানি ইউরোপের প্রভুত্ব অর্জন করে।

জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ

বিসমার্ক পরপর এইসব যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে মাত্র নয় বৎসরের মধ্যে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে বিসমার্ক স্বয়ং বলেন—জার্মানির ঐক্য ছিল তিনটি যুদ্ধের ফলশ্রুতি। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি প্রাশিয়ার রাজা উইলিয়মকে জার্মানির সম্রাট বা কাউজার বলে ঘোষণা করা হলে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। বিসমার্ক হন ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলার (প্রধানমন্ত্রী) এবং বার্লিন হয় জার্মানির রাজধানী। এর অল্পদিনের মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ জার্মানি ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

Leave a reply