নেপোলিয়ানের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
কেবল একজন সমরকুশলী সেনানায়ক বা রণনিপুণ যোদ্ধা হিসেবেই নয়—একজন সুশাসক, সংস্কারক ও সংগঠক হিসেবেও নেপোলিয়ন তাঁর অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ঐতিহাসিক ফিশার বলেন, “নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিত্তির ওপর স্থায়িভাবে নির্মিত হয়”।
ফিশার-এর মতে, তিনি ফরাসী বিপ্লবের তিনটি আদর্শ—সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মধ্যে কেবল সাম্য নীতিকেই কার্যকরী করেন। স্বাধীনতার আদর্শ অনুযায়ী পূর্বে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও তা চরম বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। এর ফলে স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নেপোলিয়ন একটি কেন্দ্রীভূত স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ফিলিপ গুয়েদালা-র মতে, তিনি স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিলেও, সাম্য নীতি প্রয়োগ করে তার ক্ষতিপূরণ করেন।
নেপোলিয়নের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব হল বিপ্লব ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে আইনের শাসন প্রবর্তন করে দেশবাসীর মনে শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ সুনিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি কেন্দ্রীভূত স্বৈরশাসন গড়ে তোলেন এবং শাসনব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ আধিপত্য স্থাপন করেন। প্রথম কনসাল হিসেবে তিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন। আইনসভা চারটি কক্ষে বিভক্ত হয়। একমাত্র নিম্ন কক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হলেও বকি তিন কক্ষের সদস্যরা প্রথম কন্সাল দ্বারা মনোনীত হতেন। প্রথম কন্সালের সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনসভায় পেশ করা যেত না বা আইনসভায় পাস হলেও কোন বিল আইনের মর্যাদা পেত না। সমগ্র দেশকে মোট ৮৩টি প্রদেশ বা ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত করা হয়। প্রদেশগুলি আবার জেলায় বিভক্ত ছি। প্রদেশ ও জেলাগুলির শাসনকর্তা অর্থাৎ ‘প্রিফেক্ট’ ও ‘সাব-প্রিফেক্ট’ এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের তিনি নিয়োগ করতেন। মন্ত্রী, আমলা, বিচারক, সেনাপতি—সব পদস্থ কর্মচারীই তাঁর দ্বারা নিযুক্ত হত। নির্বাচন দ্বারা সরকারি কর্মচারী নিয়োগ নিষিদ্ধ হয়। প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি-নির্ধারণ বা আইন-প্রণয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন সব ক্ষমতাই তাঁর হস্তগত হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এইভাবে তিনি ফ্রান্সে গণতন্ত্রের মুখোশে এক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .