জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ রাজবংশের পরিবর্তে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ। কিন্তু ১৮ বছরের মধ্যেই ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আর-এক অভ্যুত্থানে এই জুলাই রাজতন্ত্রের-ও পতন হয়, ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব-পূর্বেকার অস্তির ফ্রান্সের বর্ণনা প্রসঙ্গে আলেক্সিস দ্য তবিল বলেন—আমরা একটি আগ্নেয়গিরির ওপরে ঘুমিযে আছি….বিপ্লবের হাওয়া বইছে, দিগন্তে ঝড়ের আভাস।
জুলাই রাজতন্ত্রের পতন বা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ
(১) রাজতন্ত্রের দুর্বল ভিত্তি
ফ্রান্সের উদারতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী, বোনাপার্টিস্ট, সমাজতন্ত্রী প্রভৃতি দল ঐক্যবদ্ধভাবে চিরকালের মতো বুরবোঁ রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম হলেও বিপ্লব-পরবর্তীকালের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো কী হবে, তা নিয়ে একমত হতে পারেনি। তার ওপর পার্লামেন্টের ৪৩০ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ২১৯ জনের ভোটে উদারতন্ত্রী দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেছিলেন। ফলে সর্বসম্মতভাবে রাজা নির্বাচিত না হওয়ায় জুলাই রাজতন্ত্রের ভিত্তি ছিল দুর্বল।
(২) রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতা
রাজতন্ত্রের প্রতি প্রবল ক্ষুব্ধ প্রজাতন্ত্রীরা ছাড়াও সে সময়ে ফ্রান্সের অসন্তুষ্ট অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নানা কারণে জুলাই, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু করে। যেমন—
(ক) বুরবোঁপন্থীদের বিরোধিতা
বুরবোপন্থীরা মনে করতেন জুলাই রাজতন্ত্র ছিল অবৈধ ও ফিলিপ ছিলেন বেআইনি শাসক। তারা দশম চার্লসের পৌত্র কাউন্ট অব চ্যামবোর্ডকেই বৈধ রাজা বলে মনে করত।
(খ) বোনাপার্টিস্ট দলের বিরোধিতা
মধ্যপন্থী বোনাপাটিস্ট দল লুই ফিলিপ-এর হতাশাজনক বৈদেশিক নীতির সঙ্গে নেপোলিয়নের গৌরবোজ্জ্বল বৈদেশিক নীতির তুলনা করে ফিলিপের দুর্বল শাসনের অবসান চায় এবং নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নেপোলিয়নকে সিংহাসনে বসাতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
(গ) সমাজতন্ত্রী দলের বিরোধিতা
লুই ব্লাঙ্ক, সেন্ট সাইমন, প্রুধোঁ, চার্লস ফ্যুরিয়ার প্রমুখের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দল রাজা ফিলিপের অর্থনীতির প্রচণ্ড সমালোচনা ও বিরোধিতা শুরু করে।
(ঘ) যাজকপন্থী দলের বিরোধিতা
যাজকশ্রেণির হাত থেকে শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব কেড়ে নেওয়ার ফলে যাজকশ্রেণিও লুই ফিলিপের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরোধিতা করে জুলাই রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ চায় ।
(ঙ) প্রজাতন্ত্রী দলের বিরোধিতা
লুই ফিলিপ সম্পত্তিতে ভোটাধিকারের মানদণ্ড নির্ধারিত করলে বহু গরিব মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারায়। তাই এই দল জুলাই রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে।
(৩) বুর্জোয়া-নির্ভরতা
শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলির পূর্ণ সমর্থন না পেয়ে লুই ফিলিপ ক্রমে বুর্জোয়াশ্রেণির মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠেন। যুদিও বুর্জোয়াদের বিরাট একটা অংশের সমর্থন তিনি লাভ করতে পারেনি। এভাবে নিজ স্বার্থের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় উদাসীন হয়ে পড়েন। ফলে নাগরিক রাজা হিসেবে যে জনপ্রিয়তা তিনি লাভ করেছিলেন তা ক্রমেই হারিয়ে যায়। জনসাধারণ আর একটা বিপ্লবের প্রয়োজন উপলব্ধি করে।
(৪) শ্রমিক বিক্ষোভ
ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের প্রথম পর্বে শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। শিল্পবিপ্লবের ফলে সেখানে কলকারখানা গড়ে ওঠে, কিন্তু কোনো সুষ্ঠু শিল্পনীতি গড়ে ওঠেনি। ফলে কম মজুরিতে শ্রমিকদের বেশি সময় খাটতে বাধ্য করা হত। তাদের ন্যায্য দাবিকে পদদলিত করে শিল্পপতিরা অধিক ধনী হতে শুরু করে।
লুই ব্লাঙ্ক মন্তব্য করেন—এই অর্থনৈতিক দুর্গতি থেকে শ্রমিকদের মুক্তিলাভের জন্য প্রথমেই বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের অবসান প্রয়োজন।
(৫) অর্থনৈতিক সংকট
লুই লিফিপের শাসনকালে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকটও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে শস্যহানির ফলে বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে মন্দা বেকার সমস্যাকে চরমে পৌঁছে দেয়। এইসব সমস্যা সমাধানে অক্ষম সরকারের পতন ঘটাতে ফ্রান্সবাসী তৎপর হয়ে ওঠে। লা-ভেন্ডি, বোলন, স্টাসবুর্গ, লিও ইত্যাদি অঞ্চলে বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল এই অর্থসংকট।
(৬) দুর্বল বিদেশনীতি
বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও লুই ফিলিপ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। জাতির গৌরব বৃদ্ধির জন্য কোনো বৈদেশিক নীতি গ্রহণ না করার ফলে বোনাপার্টিস্টরা যেমন তাঁকে কাপুরুষ হিসেবে ঘৃণা করতে শুরু করে, পার্লামেন্টেও তেমনি এ ব্যাপারে তিনি নিন্দিত হন। বিদেশনীতি নির্ধারণে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। এক্ষেত্রে তাঁর ভয় ছিল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাকে হয়তো ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সিংহাসন থেকে উচ্ছেদ করবে। ফরাসি জনগণও তাঁর ‘বন্ধ্যা ও নিষ্ফলা বৈদেশিক নীতির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।
(৭) লুই ফিলিপের মধ্যপন্থা নীতি
লুই ফিলিপ বিপ্লবের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও মধ্যপন্থা নীতি মেনে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ফলে তিনি ফ্রান্সে বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী রক্ষণশীল বা উদারপন্থী কোনো দলেই আস্থা অর্জন করতে পারেননি। তাঁর এই ব্যর্থতা বিপ্লব ডেকে আনে।
(৮) পরিবর্তনবিমুখ অভ্যন্তরীণ নীতি
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে লুই ফিলিপ ও তাঁর মন্ত্রী গিজো পরিবর্তনবিমুখ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। ভোটারের সংখ্যাবৃদ্ধি, প্রতিনিধি সভার গঠন পালটানোর দাবিকে অস্বীকার করা হয়। প্রতিনিধি সভায় কৃত্রিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে বলপূর্বক জনবিরোধী শাসন কায়েম করা হয়।
(৯) ভোটাধিকার সংস্কার ও সম্প্রসারণের দাবি
যে উদারতন্ত্রী দলের সমর্থনে ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেছিলেন, থিয়ার্সের নেতৃত্বে সেই দল ভোটাধিকার সংস্কার ও সম্প্রসারণের দাবি জানায়। রাজা ফিলিপ ও তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল প্রধানমন্ত্রী গিজো তা মানতে অস্বীকার করেন। এ ছাড়াও (১) সেপ্টেম্বর আইন’ দ্বারা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা নিষিদ্ধ করা হয়। (২) জুরি দ্বারা বিচারের সুযোগ বাতিল করা হয়। এবং (৩) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। এভাবে লুই ফিলিপের সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তাই থিয়ার্স ধিক্কারের সুরে বলেন—ফরাসি পার্লামেন্ট হল একটি বাজার যেখানে সদস্যরা তাঁদের বিবেক বিক্রি করেন।
(১০) জনতার ওপর গুলিবর্ষণ
লুই ফিলিপের দমনমূলক আচরণে হতাশ উদারতন্ত্রী দল শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি (১৮৪৮ খ্রি.) প্যারিসের ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে। কিন্তু সরকার ওই সভা নিষিদ্ধ করলে জনতা গিজোর পদত্যাগ দাবি করে এবং তাঁর বাসগৃহের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। ওই সময় গিজোর দেহরক্ষীরা জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করলে ২৩ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।
বিপ্লবের শুরু ও রাজতন্ত্রের পতন
জনতার ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদে প্যারিসের সর্বত্র উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে এবং রাজার পদচ্যুতির দাবিতে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হয়। (২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ খ্রি.)। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে ২৪ ফেব্রুয়ারি দশ বছরের পৌত্র কাউন্ট প্যারিসের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করে লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। এর সঙ্গে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .