স্থিতিশীল উন্নয়নের উদ্দেশ্যসমূহ
জাতিধর্ম-নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণসাধন স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য। ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের মতে মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য পাঁচটি মূল বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই বিষয়গুলি হল—
(i) সামাজিক বিকাশ
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তাই সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা ও সংস্কার মানুষকে তার শৈশব থেকে প্রভাবিত করে। যে সব সামাজিক বিধি-নিষেধ, কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেগুলিকে দূর করার জন্য সমাজকে অরও জনমুখী করা দরকার, তবেই সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
(ii) অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি
স্থিতিশীল উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য— অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি কারণ অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ছাড়া জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা যায় না, কৃষি-শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হয় না। মানুষের আয় বাড়লে তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে এবং চাহিদা বাড়ে। ফলে পণ্যসামগ্রীর জোগান বৃদ্ধি পায় এবং দেশের আর্থিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় হয়।
(iii) সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি
শিক্ষা-জ্ঞান-বুদ্ধি, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, কলা, আইন, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি হল মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতির সমৃদ্ধি মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। সভ্যতার উৎকর্ষ বাড়ায় এবং প্রাকৃতিক ও মানবিক বাধাগুলিকে দূর করে। সম্পদ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে সংস্কৃতি যত উন্নত হবে, সম্পদের স্রষ্টা হিসাবে মানুষ তত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
(iv) বাস্তুতান্ত্রিক ক্রমোন্নতি
পৃথিবীর সজীব উপাদান— উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানুষ এবং জড় উপাদান সৌরশক্তি, জল, বায়ু, মাটি প্রভৃতির পারস্পরিক সম্পর্কই হল বস্তুতন্ত্র। পৃথিবীতে এই সজীব ও জড় উপাদানগুলির মধ্যে সম্পর্ক চিরন্তন এবং এরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। সৌরশক্তি, জল, মাটি ছাড়া গাছপালা বেঁচে থাকতে পারে না। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের জন্য মানুষ যদি সব গাছপালা কেটে ফেলে তাহলে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত কমে যাবে, চাষ-আবাদ ব্যাহত হবে এবং মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস পাবে। তাছাড়া বায়ুমণ্ডলে দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে, ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। তাই স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারণায় পরিবেশের এই সজীব ও জড় উপাদানগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ বাস্তুতন্ত্রের উন্নতি হলে তবেই মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে।
(v) ভৌগোলিক অবস্থার উন্নতি
ভূ-পৃষ্ঠের সমভূমি, মালভূমি, পাহাড়, মরুভূমি, বনভূমি, জলাভূমি সর্বত্রই মানুষ বসবাস করে। পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষের বাসভূমি হলেও অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা যেখানে বেশি সেখানেই মানুষের বসতি বেশি। স্থিতিশীল উন্নয়নে তাই মানুষের পারিপার্শ্বিক ভৌগোলিক অবস্থার উন্নতির উপর জোর দিতে বলা হয়েছে। কারণ ভৌগোলিক অবস্থার অবনতি হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .