Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের ধারণা ক্রমেই পরিণত লাভ করতে থাকে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলা। বাংলায় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের প্রসার স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে মোটেই নিরাপদ ছিল না। ফলত বাংলার জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য সরকার বিভেদ নীতির আশ্রয় নিয়ে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করেছিলেন।

বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য

বঙ্গভঙ্গের পিছনে শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে পশ্চিমবাংলাকে সংযুক্ত করে হিন্দু বাঙালিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। এছাড়া পুর্ব বাংলাকে একস্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত করে হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষের সৃষ্টি করা। এই সব উদ্দেশ্যেই লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৬ই জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে ঘোষণা করেন।

আন্দোলনের সূচনা

বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বেঙ্গলি পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে ‘এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়’ বলে মন্তব্য করেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে প্রায় দুই হাজার সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিন দ্বিখন্ডিত বাংলার যুক্ত প্রতীক হিসাবে কলকাতার ‘ফেডারেশন হলের’ ভিত্তি স্থাপিত হয়। ওই দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে জাতিধর্মনির্বিশেষে একে অপরের হাতে ভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসাবে রাখী বাঁধে। বাংলার ঘরে ঘরে অরন্ধন পালিত হয়।

বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন

শুধুমাত্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ানো অসম্ভব বিবেচনা করে, আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বয়কট অর্থে শুধুমাত্র বিলেতি বস্ত্র বা পণ্যসামগ্রীই নয়, বিলেতি চিন্তাধারা, আদবকায়দা সবকিছুই বর্জন করার আদর্শ প্রচার করেন। বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টিই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

এছাড়া বয়কটের পরিপূরক হিসেবে স্বদেশি চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। ‘স্বদেশি’র অর্থ ব্যাখা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘কেবল স্বদেশিদ্রবই নহে, সর্বপ্রকার বিদেশী আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা পদ্ধতি ও রাজনৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও পন্থা জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করে।’ বস্তুত স্বদেশিও বয়কট এই দুই কর্মপন্থা অবলম্বন করে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা সার্বিকভাবে স্বদেশি আন্দোলন নামে পরিচিত।

স্বদেশি আন্দোলনের প্রসার

স্বদেশি আন্দোলন বাংলাদেশে প্লাবনের মতো প্রসার লাভ করে। গ্রামে-গঞ্জে সভাসমিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশিদ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হয়। ক্রমশ রাজনীতির সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা শিল্পের জগতেও স্বদেশি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়।

স্বদেশি শিল্পের বিস্তার

স্বদেশি আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুটির শিল্প এবং দেশীয় পরিচালনায় বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বংলায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন। ডাঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাজে চিদাম্বরম ‘পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল স্যার জামসেদজী টাটা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহও ইস্পাত কারখানা।

ছাত্রসমাজের ভূমিকা

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিদেশি কাগজ, কলম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করে। এমনকি তারা বিদেশি কাপড়, লবণ, চিনি, মদ, প্রভৃতি দোকানের সামনে পিকেটিং করে। ছাত্রদের দমন করার জন্য রকার ‘কার্নাইল’ সার্কুলার জারি করেন। বহিস্কৃত ছাত্রদের শিক্ষালাভের জন্য জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় এবং এই উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠিত হয় (মার্চ ১৯০৬)

জাতীয় শিক্ষার বিস্তার

স্বদেশি আন্দোলনের যুগে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ২৪ টি মাধ্যমিক ও ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এমনকি জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলারবাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

সাহিত্য সংস্কৃতি

স্বদেশি আন্দোলনের যুগে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য, সংগীত ও নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ প্রচলিত হয়। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বদেশি শিল্পকর্মে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

সংবাদপত্রের ভূমিকা

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রচারে এবং স্বদেশি আন্দোলনের যুগে সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ক্ষেত্রে কৃয়কুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বেঙ্গলি’, বিপিনচন্দ্র পাল সম্পাদিত ‘বন্দেমাতরম’, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘যুগান্তর’ এবং ব্রশ্নবান্ধব উপপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়

আন্দোলনের অবসান

প্রবল সরকারি দমন নীতির চাপে কলকাতায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে। তবে পূর্ব বাংলায় ঢাকা ও বরিশালে স্বদেশি আন্দোলন ক্রমশ গণমুখী ও গতিশীল হয়ে ওঠে। অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ বান্ধব সমিতির ১৫৯ শাখার মাধ্যমে বরিশালকে আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করেন।

মূল্যায়ন

আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন ব্যর্থ মনে হলেও তা প্রকৃত অর্থে ব্যর্থ হয়নি, কারণ এই আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করতে সাহায্য করে।

Leave a reply