সূচনা:
সাধারণভাবে লােককথাকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা রূপকথা, পরিকথা, পশুকথা, কিংবদন্তি, লােকপুরাণ বা মিথকথা, নীতিকথা, গীতিকা, ব্রতকথা। নীচে সংক্ষেপে সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হল।
লােককথার শ্রেণিবিভাগ ও ব্যাখ্যা
রূপকথা
আত্মপ্রকাশ: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রূপকথার মধ্যে দিয়েই লােকসাহিত্যের লিখিত রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে গ্রিম ভাইয়েরা রূপকথার প্রথম লিখিত সংকলন (প্রথম খণ্ড) প্রকাশ করে রূপকথার পরিচয় ঘটান।
মর্মার্থ: জার্মান ভাষার ‘মারচেন কিংবা সুইডিশ ভাষার সাগা রূপকথার মর্মার্থ প্রকাশ করে। এ ছাড়াও ইংরেজি ফেয়ারি টেল’, জার্মান ম্যৰ্শেন, রুশীয় স্কাজঈ এবং ফিনীয় সাগেন হল রূপকথার সমধর্মী।
চরিত্র: রূপকথার চরিত্রগুলি সাধারণত কাল্পনিক হয়ে থাকে। রূপকথায় বর্ণিত কয়েকটি চরিত্র হল রাজা রানি, মন্ত্রী-কোটাল, রাজপুত্র রাজকন্যা, দাস-দাসী, রাক্ষস-দৈত্য-ডাইনি-জাদুকর, পেতনি প্রভৃতি। এ ছাড়াও রূপকথায় থাকে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি, পক্ষীরাজ ঘােড়া, শুকপাখি এবং কিছু কল্পিত পশু।
কাহিনি: রূপকথার কাহিনি বিশ্লেষণে দেখা যায় রূপকথার নায়ক বা নায়িকা সাধারণত কঠিন ও দুরূহ কাজকে অতি সহজে সম্পন্ন করে সাফল্য পায়। অনেক সময় জাদুশক্তি সম্পন্ন কোনাে বস্তু বা ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে রূপকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র তার প্রতিপক্ষ (রাক্ষস, ডাইনি প্রভৃতি)-দের পরাজিত করে। রূপকথাতে অতিলৌকিক কাহিনি পরিবেশিত হয়।
পরিকথা
সংজ্ঞা: লােককথার আলােচনায় পরিকথা এক স্বতন্ত্র বিষয়। যে পরি কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বা মুখ্য ভূমিকা পালন করে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায় অর্থাৎ যে লােককথায় পরিকে কেন্দ্র করেই কাহিনি আবর্তিত হয় তাকেই বলা হয় নির্ভেজাল পরিকথা।
চরিত্র: পরিকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল পরি স্বয়ং। পরিরা ভালােমন্দ দুধরনেরই হয়ে থাকে। পরিরা অপরূপ রূপবতী হয়, তারা সব সময় সাদা পােশাক পরে থাকে। তারা লজ্জাবতী ও বিনয়ী হয়। তারা কম কথা বলে এবং মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। পরি চরিত্রের পাশাপাশি রূপকথার মতােই বেশ কয়েকটি অন্যান্য চরিত্রের সমাবেশ লক্ষ করা যায়।
কাহিনি: পরিকথায় পরিকে কেন্দ্র করেই কাহিনি বিন্যাস হয়ে থাকে। পরিরা দূর আকাশে থাকে, তারা অতিলৌকিক কাজের সম্পাদনের দ্বারা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে থাকে। রূপকথার মতােই পরিকথার কাহিনিরও শুরু এবং সমাপ্তিও প্রায় একই ধরনের। ইউরােপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রূপকথাগুলিতেই পরিকথার আধিক্য লক্ষ করা যায়। বিদেশি জনপ্রিয় পরিকথা হল ‘সিন্ডারেলা এবং স্লিপিং বিউটি’ গল্প দুটি।
পশুকথা
পরিচিতি: পশুকে নিয়ে কল্পিত গল্পকে পশুকথা বলে। লােককথার বিভিন্ন ভাগগুলির প্রাচীনত্বের বিচারে পৌরাণিক কাহিনি (Myth)র পরেই এর স্থান।
চরিত্র: পশুকথায় পশুপাখিদের বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলি তুলে ধরা হয়। পশুকথায় পশু, মানুষ, অতিলৌকিক প্রাণী সব মিলেমিশে উপস্থিত হয়। ভবিষ্যৎ বলা শুকপাখি, কথা বলা বানর, উপকারী কুকুর, পণ্ডিত শেয়াল, বােকা কুমির, ধূর্ত শেয়াল, চটপটে খরগােশ, অকৃতজ্ঞ সাপ, উপকারী পাখি এরা সকলেই পশুকথার চরিত্র।
কাহিনি: নানা ধরনের অলৌকিক ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে পশুকথার কাহিনি বর্ণিত হয়। পশুকথার কাহিনিতে পশুর মানবসুলভ ও পশুসুলভ উভয় ধরনের দোষগুণ ধরা পড়ে। পশুকথার কাহিনিগুলি আকারে ছােটো হয়। এর কাহিনিতে মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হীনতা-ক্ষুদ্রতা, বীরত্ব বুদ্ধি সবই পশুপাখির প্রতীক হিসেবে প্রকাশিত হয়।
উপসংহার:
লােককথাগুলি অনেকাংশে প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .