মিথ (পৌরাণিক বা কল্পকাহিনি)
মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি হল প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন কাহিনি বা ঘটনার বিবরণ, যেগুলির ভিত্তি হল মানব সভ্যতার উদ্ভবের পূর্বে ঐশ্বরিক জগতে সংঘটিত হওয়া নানান কাল্পনিক ঘটনা। এটি সাহিত্যের সর্বপ্রথম রূপ, যা এককথায় হল মৌখিক ইতিহাস।
[1] বিষয়বস্তু: পৌরাণিক কাহিনির বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে থাকে— [i] নৈসর্গিক ঘটনাবলি, যেমন—ঋতু পর্যায়, সূর্য-চন্দ্রকে নিয়ে কাল্পনিক গল্পকথা ইত্যাদি। [ii] দেবদেবী সংক্রান্ত বিষয়, যেমন—দেবী দুর্গার কাহিনি, বিভিন্ন দেবতার কাহিনি, দেবতার সাথে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক কাহিনি ইত্যাদি।
[2] বৈশিষ্ট্য: মিথ বা পৌরাণিক কাহিনির বৈশিষ্ট্যগুলি হল— [i] এগুলি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। [ii] এই সকল কল্পকাহিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগে মৌখিকভাবে রচিত। [iii] মিথ হল অলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় জগতের বিবরণ। [iv] কোনাে সমাজ ও সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি হল এইসব পৌরাণিক কাহিনি।
[3] উদাহরণ: পৃথিবীতে বহু পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হল— [i] হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, যেমন—দেবী দুর্গার কাহিনি। [ii] বাইবেলের পৌরাণিক কাহিনি, যেমননােয়া-এর কাহিনি। [iii] গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি, যেমন—দেবরাজ জিউসের কাহিনি। [iv] রােমের পৌরাণিক কাহিনি, যেমন—রােমুলাসের জীবনকাহিনি ইত্যাদি।
লেজেন্ড (কিংবদন্তি)
কিংবদন্তি হল অতীতের কোনাে চরিত্রের এমন সব ঘটনার বিবরণ, যা অতীতে একসময় ঘটেছিল এবং সেসব চরিত্র জীবন্ত ছিল বলে লােকসমাজ বিশ্বাসও করে থাকে।
[1] বিষয়বস্তু: কিংবদন্তির বিষয়বস্তু হল এখানে অতীতের কোনাে চরিত্রকে অতিমানবরূপে তুলে ধরা হয়। এখানে বাস্তব অপেক্ষা কল্পনার আধিক্য বেশি থাকে।
[2] বৈশিষ্ট্য: লেজেন্ড বা কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্যগুলি হল— [i] কিংবদন্তিগুলিতে বিস্ময় ও কল্পনার আধিক্য থাকে। [ii] এর অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অতিরঞ্জন করার প্রবণতা। [iii] প্রতিটি কিংবদন্তিতে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে এবং সেই চরিত্র একসময় জীবন্ত ছিল বলে মনে করা হয়। [iv] কিংবদন্তিতে ভিত্তিহীন ঘটনার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।
[3] উদাহরণ: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য কিংবদন্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন-ভারতের রামচন্দ্র, গােপাল ভাড়, শ্রীকৃষ্ণ, গ্রিসের হারকিউলিস, প্রমিথিউস, ইংল্যান্ডের রবিন হুড প্রমুখ।
ইতিহাস রচনায় মিথ ও লেজেন্ডের গুরুত্ব
[1] মিথ-এর গুরুত্ব:
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মিথগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন—
অতীতের দর্পণ হিসেবে: পৌরাণিক কাহিনিগুলি হল, ‘গল্পের আকারে সত্য ঘটনার প্রকাশ। তাই পৌরাণিক কাহিনিকে সঙ্গী করে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা যায়। এই পৌরাণিক কাহিনিকে সম্বল করেই গ্রিসের প্রাচীন ট্রয় নগরী ও ট্রয় যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নির্ণয় করা গেছে।
সময়কাল নির্ণয়: পৌরাণিক কাহিনি অতীতের অনেক ধারাবাহিক ছবি তুলে ধরে, ফলে এর মাধ্যমে ইতিহাসের সময়কাল নির্ধারণ করা যায়। পৌরাণিক কাহিনিগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই করে ইতিহাসের বহু সাল, তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
বংশতালিকা নির্ধারণ: পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে প্রাচীনকালের বিভিন্ন রাজবংশের তালিকা জানা যায়। ঐতিহাসিক ড. রণবীর চক্রবর্তীর মতে, পুরাণে বর্ণিত বংশগুলির অস্তিত্বের বেশিরভাগই স্বীকৃত সত্য।
ধর্ম-সংস্কৃতির অতীত ধারণালাভ: পৌরাণিক কাহিনি থেকে অতীতের সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেছেন, বর্তমানে যা হিন্দুধর্ম বলে প্রতিভাত হয়, তার মুখ্য পরিচয় পুরাণে পাওয়া যাবে।
[2] কিংবদন্তির গুরুত্ব:
মিথের মতাে কিংবদন্তিও ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন—
সভ্যতা নিরূপণ করা: বহু ক্ষেত্রেই কিংবদন্তি কাহিনিগুলিকে ইতিহাসের দর্পণে ফেলে সত্যকে তুলে ধরা হয়। যেমন- বাংলার কিংবদন্তি চরিত্র রঘু ডাকাতের কালীপূজার ভিত্তিতে বর্তমানে একটি কালী মন্দিরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ভিত্তি: কিংবদন্তি কাহিনিগুলি ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যেমন—কিংবদন্তি চরিত্র বিক্রমাদিত্যের কার্যকলাপ আসলে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তেরই কার্যকলাপের বিবরণ।
নতুন ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার: কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। বিভিন্ন কিংবদন্তির সূত্র ধরে পূর্ববঙ্গের সীতারকোটে পরীক্ষামূলক খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে (১৯৬৮ খ্রি.)।
আর্থসামাজিক অবস্থার ধারণা দান: কিংবদন্তিগুলি সমকালীন আর্থসামাজিক অবস্থাকেও তুলে ধরে। সমকালীন সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক চিত্র উঠে আসে কিংবদন্তির হাত ধরে। যেমন- রবিন হুড কিংবদন্তি চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজে ধনীদরিদ্র বৈষম্যের দিকটি উঠে আসে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .