বীরগাথা বা কিংবদন্তির গুরুত্ব
কিংবদন্তির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তা একেবারে গুরুত্বহীন নয়।
[1] ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস: কিছু কিংবদন্তি থেকে আমরা ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস পাই। লােকমুখে পুরুষানুক্রমে কাহিনি প্রচারিত হলেও সেগুলির মধ্যে ইতিহাসের তথ্যসূত্র লুকিয়ে থাকে। কিংবদন্তির প্রেক্ষাপটেই পূর্ববঙ্গের সীতারকোট-এর উঁচু ঢিবিতে পরীক্ষামূলকভাবে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
[2] আনন্দদান: কিংবদন্তির চরিত্র বা ঘটনাগুলির অলৌকিক কাহিনি পাঠ করে পাঠককুল আনন্দ পায়। অনেক সময় কাল্পনিক হলেও পাঠকের কাছে তা বিশ্বাসযােগ্য হয়ে ওঠে বলে কিংবদন্তি পাঠ আনন্দ দান করে।
[3] প্রবহমান ঐতিহ্য: নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি দেশ বা জাতি অঞ্চলে একটি বিশেষ পরিমণ্ডলের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে কিংবদন্তি দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এক বিশেষ অঞ্চলের ঐতিহ্যের মধ্যে কিংবদন্তি গড়ে উঠলেও তাই পরবর্তীকালে প্রবহমান ঐতিহ্য রূপান্তরিত হয়।
[4] শিক্ষাদানে: কিংবদন্তির চরিত্রগুলির কর্মকাণ্ড আমাদেরকে নৈতিকতার শিক্ষা দান করে বলা চলে। সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, অনমনীয় দৃঢ়তা, সাহসিকতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, উদারতা, মানবিকতা এসবের প্রতি গুরুত্বদান নৈতিকতার শিক্ষাকেই সমৃদ্ধ করে।
কিংবদন্তি ও পৌরাণিক কাহিনির পার্থক্যসমূহ
কিংবদন্তি (Legends)
- মানুষ এর মূল চরিত্র। এতে কাহিনির মূল চরিত্র মানবতার ওপর আরােপিত। মূল চরিত্রটি মানুষের বীরত্বমূলক কর্মকাণ্ড বা বীরগাথার পরিচায়ক।
- কাহিনিগুলির ঐতিহাসিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। বিশেষ অঞ্চলের সংস্কার, লােকাচার, লােকবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কিংবদন্তি গড়ে ওঠে।
- সংস্কৃতি বিজ্ঞানীরা কিংবদন্তিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন যথা- [i] ব্যক্তিকেন্দ্রিক, [ii] স্থান-কেন্দ্রিক, [iii] বস্তুকেন্দ্রিক, [iv] আধ্যাত্মিক ও লৌকিক প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক, [v] প্রকৃতিকেন্দ্রিক, [vi] অদৃশ্য ও অলৌকিক বিষয়ভিত্তিক, [vil] দেব-দেবীকেন্দ্রিক, [vill] মেলা ও উৎসবকেন্দ্রিক প্রভৃতি।
- লােকসাহিত্য, লােককাহিনি, গাথা-গীতিকা, বিচিত্র জনশ্রুতি, লােকবিশ্বাস ইতিহাস, বা অর্ধ ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি, প্রেম-বিরহের গাথা, অধ্যাত্ম্যবিষয়ক কাহিনি, সন্ন্যাসী-ডাকাত-পরি-ভূত প্রভৃতির ঘটনা এর বিষয়বস্তু হয়ে থাকে।
- এতে বর্তমান সময়ের নিরিখে যথাযথভাবে ঘটনাভিত্তিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে।
- এটির রচনাকালে ক্ষীণভাবে হলেও ইতিহাসের সূত্র থাকে। অনেকসময় এগুলির মধ্যে ইতিহাসের আদি ঘটনার প্রামাণ্য তথ্যসূত্র মেলে।
পৌরাণিক কাহিনি (Myth)
- অলৌকিক দেবদেবী এর মূল চরিত্র। এতে কাহিনির মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর আরােপিত। মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলাকাহিনি বা কর্মকাণ্ডের রূপকার।
- কাহিনিগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার ইত্যাদির ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনিগুলি গড়ে ওঠে।
- সংস্কৃতি বিজ্ঞানীরা বিশ্বজনীনতার নিরিখে পৌরাণিক কাহিনিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন যথা- [i] সৃষ্টিত্বমূলক, [ii] মানুষের উদ্ভবমূলক, [iii] সৃষ্টিমূলক, [iv] প্রলয়সূচক, [v] আগুনের অধিকার বিষয়ক, [vi] সংস্কৃতির বিকাশ বিষয়ক, |[vi] চন্দ্র সূর্য গ্রহ-নক্ষত্র কেন্দ্রিক, [vil] সামাজিক বিধি বিধান বিষয়ক, [ix] ধর্মাচার সম্পর্কিত, [x] সংস্কৃতি ধাতা (Culture Hero) বিষয়ক প্রভৃতি।
- বিশ্বসৃষ্টির রহস্য, দেবতা-মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতাদানব মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপপুণ্য সমস্ত কিছুই হল এর বিষয়।
- এতে বর্তমান সময়ের নিরিখে ঘটনাভিত্তিক ধারাবাহিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে না।
- এর মধ্যে ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্যসূত্র মেলে না। এটি মূলত ধর্মীয় কল্পকথা ও এতে অতিলৌকিক কল্পনার আধিক্য থাকে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .