মেগাস্থিনিসের সপ্তজাতি তত্ত্ব
মৌর্যযুগের সামাজিক অবস্থার বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র’ একান্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান, তেমনি গ্রীক পর্যটকও লেখক মেগাস্থিনিসের লিখিত গ্রন্থ “ইন্ডিকা” গুরুত্ব অপরিসীম। মেগাস্থিনিস এবং তার পরবর্তী গ্রিক ও রোমান লেখকের বর্ণনায় মৌর্যযুগের সমাজ জীবনের সুন্দর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। কারণ এই সকল লেখকরা অধিকাংশই সমকালিন ও প্রত্যক্ষদর্শী।
গ্রিক বিবরণী তথা মেগাস্থিনিসের বিবরণীতে ভারতীয় সমাজ তথা জনসমষ্টিকে সাতটি বিভাগ বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই মত ভ্রান্ত কারণ তিনি বর্ণ বা জাতির সমার্থক কোন গ্রিক শব্দ ব্যবহার করেন নাই। তার ব্যবহৃত শব্দটি হল “জেনস বা মেরোস”—এই দুইটি শব্দের কোনটি বর্ণভেদ বা জাতিভেদ বোঝায় না-বোঝায় সামাজিক গোষ্ঠীকে। অতএব গ্রীক বিবরণীতে সপ্তজাতির যে কথা আমরা জানতে পারি তার কোন ঐতিহাসিক তথ্যগত ভিত্তি নেই। এই সাতটি গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিন্মে দেওয়া হল- এই সাতটি গোষ্ঠী হল (১) দার্শনিক (২) কৃষক (৩) শিকারি (৪) কারিগর (৫) সৈনিক (৬) গুপ্তচর (৭) উপদেষ্টা বা প্রশাসক।
এই সাতটি গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ছিলেন “দার্শনিকগণ”। এরা সংখ্যায় কম ছিলেন। এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হত (ক) ব্রাকমেনিস (খ) সারমেনিস। অনেক ঐতিহাসিক এই দুই সম্প্রদায়কে যথাক্রমে “ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ” বলে পরিচিত করেছেন। কিন্তু মেগাস্থিনিসের বর্ণনার সঙ্গে এই সনাক্তকরণের কোন মিল নেই। ব্রাকমেনিসদের জীবনে দুটি ভাগ ছিল। প্রথম ভাগে বাল্যকাল ও যৌবনে সহজ সরল ভাবে জীবনযাপন করতেন নগর থেকে অনেক দূরে বসবাস করতেন। এই ভাবে তাদের ৩৭ বছর জীবন যাপন করতে হত। দ্বিতীয় ভাগে তারা গৃহে ফিরে এসে আরামে জীবন যাপন করত।
অন্যদিকে সারমেনিস নামে পরিচিত দার্শনিকদের আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এরা ছিলেন বেশী সম্মানীয় এবং অরণ্যবাসী। আর অন্য গোষ্ঠী ছিল চিকিৎসাজীবী। এরা বিনা পারিশ্রমিকে গৃহস্থের চিকিৎসা করতেন। এদেরকে রাজা, গোষ্ঠীপতিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আহ্বান করতেন এবং সম্মান প্রদান করতেন। এই দার্শনিকগণ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস ঘোষণা করতেন।
দার্শনিকদের পরেই মেগাস্থিনিস কৃষকদের কথা বলেছেন। সমাজে এরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের স্বভাব ছিল অতি নম্র। এরা জমির মালিক ছিলেন না। রাজার জমিতে কর প্রদানের বিনিময়ে আসল উৎপাদন করতেন, যুদ্ধের সময়ও কৃষকদের শত্রু বা মিত্রপক্ষ কোন রূপ ক্ষতি করত না। এরা সাধারণত গ্রামেই বাস করত।
তৃতীয় গোষ্ঠী ছিল শিকারী বা পশুপালক। বনে জঙ্গলে পশু শিকার করে আর গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করতেন। এরা সাধারণত যাযাবরের জীবিকা গ্রহণ করত।
কারিগর বা শিল্পীরা হলেন চতুর্থ বিভাগ। এরা স্বাধীনভাবে বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শিল্পকার্য করতেন। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক রাজকীয় শিল্পি ছিলেন। এরা রাজকোষ থেকে বেতন পেতেন। এদের কোন কর দিতে হত না কিন্তু অন্য শিল্পীদের রাজকর দিতে হত
পঞ্চম গোষ্ঠীতে ছিলেন সৈনিকরা। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের।
রাষ্ট্রের তথ্য সংগ্রহের কাজ ছিল পরিদর্শক বা গুপ্তচরদের। এরা ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরাও ছিলেন সরকারি কর্মচারী।
রাজার উপদেষ্টা ও প্রশাসকদের নিয়ে সপ্তম বা শেষ গোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল। রাজার অনুগত এবং বিশ্বাসী লোকেরাই এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হতেন। এদের সমাজে খুব সম্মান ছিল।
এই সকল গোষ্ঠী বৈষম্যের তীব্রতার কথাও উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস। এক গোষ্ঠীর পক্ষে অন্য গোষ্ঠীর জীবিকা গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। এমন কি এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
মেগাস্থিনিসের এই গোষ্ঠী বিভাজন ছিল কর্মভিত্তিক। সেই সময় সমাজে নিত্য নতুন বৃত্তির সৃষ্টি হচ্ছিল। এক এক বৃত্তিকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এরই প্রতিফলন ঘটেছে তার বর্ণনায়। ভারতের সনাতন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি তাঁর বর্ণনায় ধরা পড়ে নাই। এই সব ত্রুটি সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয় মেগাস্থিনিস তাঁর বর্ণনায় ভারতীয় জনসমাজের একটি বিশাল অংশকে তুলে ধরেছেন। ভারতীয় চতুঃবর্ণ সমাজের বিভিন্ন বর্ণকে অতি সহজেই তার লিখিত সাতটি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। এছাড়াও তিনি তার বিবরণে স্বগোষ্ঠী বিবাহ ও বংশানুক্রমিক বৃত্তির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় তিনি ভারতে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন। তবে এই উক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়।
উপসংহারে বলা যায় মেগাস্থিনিসের বর্ণিত সাতটি গোষ্ঠী উপরে নীচে নয়; বরং যেন পাশাপাশি একের পর এক সাজানো রয়েছে। এই খানে গ্রীক বিবরণীর সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়। কারণ ভারতীয় সমাজে গোষ্ঠীগুলির অবস্থান উচ্চ-নীচ ক্রম অনুযায়ী, অনুভূমিক নয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .