মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় অর্থশাস্ত্রের অবদান
মৌর্য রাজারা প্রায় ১৪০ বছর ভারতে রাজত্ব করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা একটি সুসংহত ও সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠন করেছিল। সাধারণত বলা যেতে পারে মৌর্যরাষ্ট্র ছিল রাজতান্ত্রিক ও এককেন্দ্রিক। এই শাসনব্যবস্থা গঠনের পেছনে কৌটিল্যের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তবে কৌটিল্য বা চাণক্যকে নিয়ে বিতর্ক আছে। তাকে পরিহার করে কৌটিল্যের রচিত “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থকে বিশ্লেষণ করে মৌর্য শাসন ব্যবস্থার একটি রূপরেখা তৈরি করা যায়।
এই গ্রন্থে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, নারীর অধিকার, বিবাহ ব্যবস্থা, পতিতাদের জীবন অপরাধ তত্ত্ব ও তার বিচার, রাজার ক্ষমতা ও ব্যবহার, মন্ত্রীদের ক্ষমতা, বিভিন্ন বিভাগীয় অধিকর্তাদের নামের তালিকা ও কার্যাবলী, গুপ্তচর ও দূতদের কার্যাবলী, প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা, রাজস্বনীতি, জমির মালিকানা, খনি ও খনিজ সম্পদ, পতিত জমির অধিকার, মুদ্রা ব্যবস্থা, দন্ড নীতি এবং সমর নীতির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাজাকে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রী ও রাজকর্মচারী উল্লেখ আছে। মহামাত্য ও অমাত্য রাজকর্মচারীর উল্লেখ আছে। রাজ্য শাসন সম্পর্কে তার বিখ্যাত উদ্ধৃত হল “প্রজা সুখে সুখং রাজ্ঞনঃ প্রজা নাম চ হিতে হিতাণী”। অর্থাৎ প্রজার সুখই রাজার সুখ।
অর্থশাস্ত্রে রাজস্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ধনীদের নিকট হতে দুই প্রকার অর্থ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। ক) কারসানাম (অতিরিক্ত কর) খ) বদনাম (বলপূর্বক হরণ)। যারা স্বেচ্ছায় রাজাকে ভূ-সম্পতি বা অর্থপ্রদান করত রাষ্ট্র কর্তৃক তাদেরকে সম্মানিত করা হয়।
অর্থশাস্ত্রে বিচারকার্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এতে ১৮ প্রকার দন্ডবিধির নিদের্শ আছে। বিচারের দন্ড সকলের ক্ষেত্রে সমান ছিল। রাজদ্রোহিতার অপরাধে কোন ব্রাহ্মণ অভিযুক্ত হলে তাকে জীবন্ত দগ্ধ করে বা জলে ডুবিয়ে হত্যার নির্দেশ অর্থশাস্ত্রে আছে। সমগ্র সাম্রাজ্যে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সাধারণ রাজপরিবার হতে নিযুক্ত হবার উল্লেখ আছে। ক্ষুদ্র প্রদেশগুলি শাসনভার রাষ্ট্রীয় উপাধিধারী কর্মচারীর উপর ন্যস্ত ছিল। জেলার শাসক ছিলেন স্থানিক। গ্রামের শাসক ছিলেন গোপ নামক কর্মচারী। “প্রদেষ্টা” নামক রাজকর্মচারী স্থানিক ও গোপদের কার্য পরিদর্শন করতেন। এছাড়াও কৌটিল্য রাজা কর্তৃক গুপ্তচর নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। “সমস্থা ও সঞ্চরা”
এই দুই শ্রেণীর গুপ্তচর ছিল।
অর্থশাস্ত্রে প্রধানত রাজতন্ত্র সম্মত শাসন ব্যবস্থার আলোচনা করা হলেও স্বায়ত্তশাসিত উপজাতি ও গ্রামগুলির উল্লেখ আছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সম্বন্ধে কৌটিল্য বিশদ আলোচনা করেছেন। তার মতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রচ্ছন্ন শত্রু সর্বদাই বিরাজ করে থাকে। এই কারণে রাজনীতিতে বৈধতা ও নৈতিকতার কোন স্থান নাই। রাজার শক্তিবৃদ্ধির জন্য কৌটিল্য চারটি নীতির উল্লেখ করেছেন ক) সাম খ) দান গ) ভেদ ঘ) দন্ড। তার মতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্থায়ী শান্তি অবাস্তব শক্তিশালী মাত্রই যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র করার ক্ষমতাকেই কৌটিল্য রাজগুণাবলীর মধ্যে অন্যতম গুণ বলেছেন।
কৌটিল্য বলেছেন যে একমাত্র অন্যের সাহায্যেই সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করা সম্ভব। সুতরাং রাজা সচিবদের নিয়োগ করবেন এবং তাদের মতামত শুনবেন। এই সচিব বলতে সাধারণত “মন্ত্রিণ” কথা বোঝানো হয়েছে এবং তারা বিভিন্ন প্রলোভনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্ম নিযুক্ত হতেন। মন্ত্রিগণ ছাড়াও আর একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল।
মৌর্যযুগের ব্যাপক কর্মচারীর বেতন ও ভাতা সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় অর্থশাস্ত্রে। রাষ্ট্রে পক্ষ থেকে কখনও এমন কিছু দেওয়া হত না যাতে স্থায়ীভাবে রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস পায়। রাজা কোন সময়ই জমি বা গ্রাম দান করতে পারতেন না। ব্রাহ্মণ্য স্বার্থের পরিপন্থী, ব্রাহ্মণ কৌটিল্যের এই নিষেধাজ্ঞা অভিনব সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য তিনি ব্যপক গুপ্তচর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্রের এদেরকে গূঢ়পুরুষ বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে এদেরকে সংস্থার ও সঞ্চারা : এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
মৌর্য শাসনব্যবস্থার সর্বনিন্ম এবং ক্ষুদ্রতম একক ছিল গ্রাম। অর্থশাত্রে এই গ্রামগুলিকে স্ব-নির্ভর ও স্ব-শাসিত কথা বলা হয়েছে। গ্রামের শাসককে গ্রামিণ বলা হত। গ্রামিণের উপরে ছিল “গোপ”। তিনি ৫-১০টি গ্রামের উপর কর্তৃত্ব করতেন। গ্রামকে তৎকালীন অর্থনীতির একক হিসাবে গণ্য করা হত। প্রতিটি গ্রাম ভাগ ও বলি নামক কর প্রদান করত রাষ্ট্রকে।
সর্বময় বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন রাজা। অর্থশাস্ত্রে “পৌর ব্যবহারিক” নামক বিচারকগণ নগরের বিচার করতেন এবং গ্রামের বিচার করতেন রজুকগণ নামক রাজকর্মচারীগণ। ফৌজদারি আইন অত্যন্ত কঠোর ছিল। মৃত্যু দন্ড প্রচলিত ছিল। আইনের চোঁখে সবাই সমান ছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .