বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের কারণ
অথবা, বৌদ্ধধর্ম প্রসারের সামাজিক পটভূমি কি ছিল?
উত্তর: জটিল ও বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা : বৈদিক যুগের শেষের দিকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও ক্রমশঃ জটিল ও বৈষম্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
(১) জাতিভেদ প্রথা সমাজে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। বৈদিক যুগের শেষের দিকে আর্য সমাজে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই চারটি শ্রেণি হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
(২) ব্রাহ্মণদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ধর্ম জীবনে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। সমাজে তাদের অবস্থান ছিল শীর্ষে এবং তারা বিশেষ সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিলেন।
(৩) কালক্রমে ক্ষত্রিয়রা শাসক শ্রেণীর মর্যাদার অধিষ্ঠিত হলেও সামাজিক দিক থেকে তারা ব্রাহ্মণদের সমতুল্য ছিলেন না।
(৪) বৈশ্যদের হাতে অর্থ থাকলেও তাদের তেমন সামাজিক মর্যাদা ছিল না।
(৫) তৎকালীন সমাজে শূদ্রের স্থান ছিল ভৃত্যের মত। ক্রমশঃ ব্রাহ্মণ্য বাদের ফলে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীরা ব্রাহ্মণদের মত মর্যাদা ও অধিকারের দাবিদার হয়।
(৬) তৎকালীন যুগের এই গোলযোগপূর্ণ সামাজিক পরিস্থিতিতে শ্রমণরা জাতিভেদহীন সমাজের কথা প্রচার করলে জনসাধারণ অনেকেই এই নব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
বৈদিক যুগের প্রথম দিকে নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিশেষ মর্যাদা অধিকারী ছিলেন এবং তাঁরা যুদ্ধবিদ্যা, অসি চালনা এমন কি সভা সমিতির অনুষ্ঠান পরিচালনাতেও নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতেন। কিন্তু বৈদিকযুগের শেষ দিকে সমাজে নারীদের মর্যাদা অনেকাংশে কমে যায়। আগের মত তারা যুদ্ধবিদ্যা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন না। এছাড়া বাল্যবিবাহ এবং পুরুষদের বহু বিবাহ প্রথা সে যুগের নারী সমাজকে দুর্বল করে তোলে। অপর পক্ষে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম যুগের নারীদের পুরুষদের সমান অধিকার দেওয়া হত। ফলে নারী সমাজ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
বৈদিক যুগের সংস্কৃত ভাষায় যাগযজ্ঞ ও ধর্ম প্রচার করা হত। সংস্কৃত ভাষা তখনকার দিনেও জনসাধারণের একটা বড় অংশের কাছে জটিল ও দুর্বোধ্য মনে হত। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্ম সাধারণত কথা পালি ভাষায় প্রচার করা হত, যা ছিল সব সাধারণের সহজবোধ্য। খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে চিন্তার রাজ্যে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তার একটি বাস্তব পটভূমি ছিল। সেই সময় ভারতীয়গণ উপজাতি জীবন অতিক্রম করে সমাজ জীবনে প্রবেশ করেছিল! অর্থনীতিতে তখন পশুপালন পর্বের পর কৃষিভিত্তিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। অনেকগুলি নগর গড়ে ওঠায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। এর ফলে বৈদিক সংস্কৃতি মধ্যদেশ অতিক্রম করে পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেছিল দেখা দিল এক ব্যাপক পরিবর্তনের হাওয়া। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষি উন্নতির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। কিন্তু বৈদিক ব্রাহ্মণরা সমুদ্র যাত্রা। সুদের কারবার প্রভৃতির ওপর নানান রকম ধর্মীয় বিধি আরোপ করেছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের এইসব বিষয়ের ওপর কোন বিধিনিষেধ প্রায় তুলে দিল।
এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্যদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বৈশ্যরা বৌদ্ধ ধর্মের মত এমন একটি ধর্মের প্রত্যাশী ছিলেন যা অকারণে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করে সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য অগ্রগতি সুনিশ্চিত করবে। ফলে বৈশ্যরাও এই যুগে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
বৈদিক যুগের শেষের দিকে লোহা আবিস্কারের ফলে, শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ব্যাপক ধর্মবৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এই সময় আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে বঞ্চিত মানুষ প্রকৃত সুখের পথ খুজতে থাকে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের জন্য বৌদ্ধ ধর্মে এ অত্যাধিক ভোগ বিলাস এবং সন্ন্যাস জীবনের পরিবর্তে মধ্যপ্রন্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, এই সময় আর্থ-সামাজিক জীবনের পরিবর্তনের ফলে ধর্মীয় জীবনেও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
এই বৌদ্ধ ধর্ম আন্দোলন ছিল আদিম ধর্ম বিশ্বাস সমন্বিত জটিল যজ্ঞকেন্দ্রিক এবং বর্ণবৈষম্য নির্ভর জীবন যাপনের ঘোর বিরোধী। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল যজ্ঞ। এই যজ্ঞ সমাজের উচ্চবর্ণের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণদের কাছে এই যজ্ঞ ছিল জীবিকার্জনের মূল্য উপায়। সমাজের অন্য দুই শ্রেণী বৈশ্য ও শূদ্রদের কাজ ছিল উদ্বৃত্ত উৎপাদন করা। আর এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা তাদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করতেন। কিন্তু পরিবর্তিত সময় যখন কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হল এবং ব্যক্তি গত মালিকানা ধারণার সৃষ্টি হল তখন যজ্ঞের গুরুত্ব হ্রাস প্রাপ্ত হল। বৈশ্যরা তাদের অর্জিত গোসম্পদ যজ্ঞের জন্য দিতে অস্বীকার করল। আবার তাদের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছিল বৌদ্ধ ধর্মমত।
বৌদ্ধ ধর্মের রাজতান্ত্রিক আদর্শের বদলে গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রতি-বেশী জোর দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম সংঘগুলো ছিল এক একটি ছোট ছোট গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ক্ষত্রিদের অবিরাম যুদ্ধের ফলে বৈশ্যদের বাণিজ্য বিপন্ন হয়েছিল। তাই বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়গুলি সকলেই এই যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এই ধর্ম কোন সামাজিক কর্মসূচী ঘোষণা করে নাই।
উপসংহারে বলা যায় যে, ইউরোপ যেমন ক্যাথলিক ধর্ম ও পোপের স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। ভারতে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তেমনি বৈদিক ধর্ম ও ব্রাহ্মণদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভার হয়। ব্রাহ্মণদের আভিজাত্য; বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্রম বর্ধমান আর্থিক সমৃদ্ধি, ক্ষত্রিয়দের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এবং সীমাহীন সাধারণ মানুষের দারিদ্রতা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভারসাম্যকে বিনষ্ট করেছিল। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর মধ্যে সম্প্রীতি ও মৈত্রী ও সহযোগিতার বাতাবরণ তৈরির প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতেই মানব প্রেমের ডাক দিলেন বুদ্ধদেব। এর ফলে সূচনা হল প্রতিবাদী মুখর সংস্কারধর্মী এক নতুন অধ্যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .