জনপদ থেকে মহাজনপদ কেমন করে হল
বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তরনিকায় এবং জৈন গ্রন্থ ভগবতীসূত্র থেকে জানা যায় যে বুদ্ধ ও মহাবীরের সময় খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে ১৬টি মহাজনপদ ছিল। জনপদ শব্দটি বলতে রাষ্ট্র বোঝায় না। বোঝায় Tribal Settlement। তাই মহাজনপদগুলিকে আমরা ঠিক রাষ্ট্র বলতে পারি না। কিন্তু আমরা দেখতে পাই অল্পদিনের মধ্যে এরা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র পরিণত হয়েছিল। বুদ্ধ ও মহাবীরের জীবদ্দশাই এরা Potential State থেকে রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং রাজতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল।
মহাজনপদগুলির নাম নিয়ে বৌদ্ধ ও জৈন তালিকায় যথেষ্ট অমিল আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুওরনিকায় অনুসারে (১) অঙ্গ (২) কাশি (৩) কোশল (4) বৃজি, (৫) মল্ল (৬) চেদি (৭) বৎস (৮) কুরু (৯) পাঞ্চাল (১০) মৎস্য (১১) শূরসেন (১২) অশ্মক (১৩) অবন্তী (১৪) গান্ধার (১৫) কম্বোজ (১৬) মগধ।
অন্যদিকে জৈন গ্রন্থ ভগবতীসূত্র অনুসারে (১) অঙ্গ, (২) বঙ্গ (৩) মগধ (৪) মলয় (৫) মালব (৬) অচ্ছ (৭) বচ্ছ (৮) কোেচ্ছ (৯) পাঢ় (১০) রাঢ় (১১) বজ্জি (১২) মোলি (১৩) কাশি, (১৪) কোশল (১৫) আবহ (১৬) সম্পৃত্তর। দুইটি তালিকা মেলালে দেখা যায় জৈন গ্রন্থে অনুসারে তালিকাটি অধিকতর ব্যাপক এবং পরবর্তী সময়ে রচিত।
এই মহাজন পদগুলি মধ্যে প্রথম দিকে কাশী ছিল সবচেয়ে শক্তিশালি। এর রাজধানী ছিল বারানসী বিভিন্ন জাতকে এই নগরীর শ্রেষ্ঠত্বের এবং এখানকার শাসকদের সাম্রাজ্যলিপ্সার পরিচয় পাওয়া যায়। কোশল একটি বহৎ রাজ্য ছিল। এতে অযোধ্যা, সাকেত এবং শ্রাবন্তী এই তিনটি প্রধান নগর ছিল। অঙ্গ রাষ্ট্রের অবস্থান ছিল মগধের পূর্বে। চম্পা নদী মগধ এবং অঙ্গের মধ্যে সীমারেখা রচনা করেছিল।
মগধ বলতে বর্তমান দক্ষিণ বিহারের পাটনা এবং গয়া জেলা বোঝাত। গয়ার নিকটবর্তী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ এর রাজধানী ছিল। রিস ডেডিডস এবং কানিংহামের মতানুসারে আটটি মৈত্রীবদ্ধ গোষ্ঠী (অষ্ঠকুল) বজ্জির অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিদেহগণ, লিচ্ছবিন, জ্ঞাতৃকগণ এবং বজ্জি প্রধান। অবশিষ্ট গোষ্ঠীগুলির পরিচয় নিশ্চিত জানা যায় না।
মল্লদের অধিকৃত অঞ্চল তখন দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল একটি অংশের রাজধানী ছিল কুশিনারা বা কুশীনগর অপর অংশের নাম পাবা। অনেকে মনে করেন, চেদিগণের দুইটি বসতি ছিল। জাতক অনুসারে এর রাজধানী ছিল শোতথিবতী, মহাভারত অনুসারে শুক্তিমতী। বৎস রাজ্যটি আর্থিক দিক থেকে বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। এই সমৃদ্ধির মূলে ছিল এখানকার উন্নত কার্পাস শিল্প। যমুনাতীরে, এলাহাবাদের নিকটবর্তী কৌশাম্বী এর রাজধানী ছিল। জাতক অনুসারে কুরুর রাজবংশ যুধিষ্ঠিরের পরিবারভুক্ত ছিল। এর রাজধানী ছিল দিল্লীর নিকটবর্তী ইন্দ্রপত্ত বা ইন্দ্ৰপত্তন বা ইন্দ্রপ্রস্থ। পাঞ্চাল বলতে বুন্দেল খন্দ এবং মধ্য দোয়াবের অংশ বিশেষকে বোঝায়।
মৎস্য বলতে বর্তমান জয়পুর বোঝায়। যমুনাতীরে অবস্থিত মথুরা সুরসেনের রাজধানী ছিল। অস্মক’র অবস্থিত সম্পর্কে সামান্য অনিশ্চয়তা আছে। ডাঃ রায়চৌধুরী মনে করেন, যে ঐ রাজ্যটি গোদাবরীর তীরে অবস্থিত ছিল। অবন্তী ছিল পশ্চিম ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। মোটামুটি ভাবে বলা চলে যে, অবত্তী বলতে বর্তমান মালব, এবং মধ্যপ্রদেশ-এর সংলগ্ন অঞ্চল বোঝাত। পুরাণ অনুসারে অবন্তী রাজ্যের প্রথম রাজবংশের নাম ছিল হৈহয়। গন্ধার বলতে পেশোয়ার এবং রাওয়ালপিন্ডি জেলার দুইটিকে বোঝায়।
কম্বোজ “উত্তরাপথের” অর্থাৎ ভারতে দূর উত্তর অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। প্রচীন সাহিত্য এবং অশোকের লেখতে গান্ধার এবং কম্বোজের নাম সর্বদা এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। দিক থেকে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এ থেকে আমরা
ঐতিহাসিক ভূগোলের মোটামুটি ভাবে, খৃ.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর রাজনৈতিক চিত্রের আভাস পাই। ভারতে তখন রাজনৈতিক ঐক্য একেবারেই ছিল না। ভারত অনেক গুলি খন্ড, ক্ষুদ্র, বিচ্ছিন্ন রাষ্টের বিভক্ত ছিল। তারা প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে কলহে লিপ্ত হত। ষোলটি মহাজন পদের অধিকাংশই ছিল বিহারে, উত্তরপ্রদেশে এবং মধ্যভারতে। আসাম, বঙ্গদেশ, ওড়িশা, গুজরাট, সিন্ধু এবং দুর দক্ষিণ অঞ্চলে কোন মহাজন পদ ছিল না। দক্ষিণ ভারতে একটি মাত্র মহাজন পদ ছিল তার নাম অস্মক।
এই জনপদগুলির রাষ্ট্রীয় ও আর্থ সামাজিক অবস্থাও ছিল বেশ চমকপ্রদ। এই সময়ের বেশির ভাগ জনপদই ছিল রাজতান্ত্রিক। এবং রাজাই ছিলেন প্রধান ও বংশানুক্রমিক। শাসন কার্যে রাজাকে সাহায্য করত আমলাতন্ত্র। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে সর্বার্থক মহাপাত্র, ব্যবহারিক, দ্রোণ মাপক মহামাত্র নাম পাওয়া যায়। গ্রাম প্রশাসনের প্রধানরা ছিলেন গ্রামভোজক এবং গ্রাম কূটক। গ্রামনীদের সাথে রাজার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শাস্তির বিধান কঠোর ছিল। ব্যবহারিক মহামাত্র বিচার কার্য সমাধা করতেন। কৃষি থেকে প্রধান রাজস্ব আসত।
এই যুগে যেমন রাজতান্ত্রিক রাজ্য ছিল তেমনি সংঘ বাগন নামে অরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও ছিল। বৃজি, মল্ল, শাক্য ভল্ল ও লিচ্ছবির এই ধরনের অরাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। সাধারণত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করত। তবে এই সকল রাষ্ট্রে অভিজাত ক্ষত্রিয়দেরই প্রধান ভূমিকা ছিল। এই সকল রাষ্ট্রের প্রধানকে বলা হত সংখমুখ্য বা গণপতি বা গণরাজ। তবে পরিষদের হাতেই ছিল রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা। লিচ্ছবিদের প্রতিনিধি সভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৭০৭জন। তবে বৌদ্ধ গ্রন্থে গণ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫০০তে ধার্য করা হয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .