আর্যদের আদি বাসভূমি
অথবা।। আর্যদের আদিবাসভূমি নিয়ে যে বিতর্ক আছে তা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ইউরোপীয় পন্ডিতগণই প্রথম ‘আর্যজাতি’ বা ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। প্রথমেই স্বরণ রাখা ভালো যে আর্য শব্দটি ভারতীয় শব্দ, ভারতেই এর বহুল প্রচার এবং এই শব্দের প্রথম উল্লেখ পাই ঋগ্বেদ ও বেদ-সংহিতায। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে পন্ডিত বপ (Bopp) গবেষণা করে বলেন যে ‘আর্য’ ভাষা একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে সাতটি ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত বা চিহ্নিত করেন। এছাড়াও এশিয়ার তিনটি ভাষা যথা ভারতীয় ইরানীয় ও আর্মেনিয়ান ভাষাকেও এই পরিবারের অন্তর্গত কারণ আচার্য ম্যাক্সম্যুলর মনে করেন যে আর্যরা এক পৃথক জাতি। যারা আর্য ভাষায় কথা বলেন, তিনিই আর্য বলে চিহ্নিত হবেন।
ইউরোপের বহু-পণ্ডিত মনে করেন আর্যভাষাগোষ্ঠী এক দিকে ভারতে অপরদিকে ইউরোপের পশ্চিম ও উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছিল। ‘আর্য’ নামে পরিচিত ভাষাভাষিগোষ্ঠির মধ্যে সংস্কৃত ও জেন্দ (পারসিক) সর্বপ্রাচীন এ বিষয়ে মতভেদ নেই।
মধ্য এশিয়া আর্যগণ আদিম বাসস্থল: এ মতবাদ প্রথমে জে.জি. রোডস (Rhodes) ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে প্রচার করেন। পারসিক ধর্মগ্রন্থ ‘ভেন্দিদাদ’ এর প্রথম অধ্যায়ে প্রদত্ত ভৌগোলিক বিবরণ সমূহ বিচার করে ব্যাকট্রিয়াই পারসিকদের আদিম বাসভূমি এই বিশ্বাসে তিনি উপনীত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময় রোডস-এর মতবাদ পন্ডিত Pott, ল্যাসেন (Lossen) সমর্থন করেন। সংস্কৃত ভাষাভাষীগণ উত্তর পশ্চিম থেকে কাবুল দিয়ে খুব সম্ভবত পাঞ্জাবে প্রবেশ করেছিল। আবেস্তার বর্ণনানুসারে পারসিকদের পূর্ব-পুরুষগণের আদি বাসভূমি ছিল নিশ্চয়ই আমু ও সিরদরিয়া নদীর উৎপত্তি স্থলের নিকট বেলুরত্যাগ (Belurtag) ও ‘মুস্তাগ’ নামের ঢালু অঞ্চলে।
১৮৪৮ সালে পন্ডিত জেবাব (Grimm) উপরের মতবাদ সমর্থন করে কিন্তু আর্যরা এশিয়া থেকে ইউরোপের অভিযানকে কাল্পনিক বলে মত প্রকাশ করেছেন। Grimm-এর মতকে সমর্থন করেছেন ম্যাকসমূল্যর। তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে আর্য ভাষাগোষ্ঠী জাতির প্রধানদল বরাবরই উত্তর পশ্চিম দিকেই অভিযান করেছিল। ভারতের ব্রাহ্মণিক আর্যগণ ও ইরাণের জোরোয়াস্টিয়ানগণ এই দক্ষিণী শাখার অন্তর্ভূক্ত ছিল। তিনি আরো মন্তব্য করেন এমন এক সময় ছিল যখন ভারতীয় পারসিকগণ গ্রীক, রোমান, স্লাভ জার্মাণদের আদি পুরুষগণ একত্রে একই আচ্ছাদনের নীচে বসবাস করত। মধ্য এশিয়ার উচ্চ মালভূমিকেই তিনি সেই অঞ্চল বলে অনুমান করেছিলেন।
এই মতবাদ একসময় ইউরোপীয় পন্ডিতদের গভীরভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। ১৮৭৪ সালে অধ্যাপক সায়ী Sayec তার Prineihles of Philology নামক গ্রন্থে লিখেছেন “আর্য ভাষা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল মধ্য এশিয়ার আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নদীয় উৎপত্তস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে।” তাঁর মতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বই আর্যভাষা ভাষীদের আদি নিবাস এশিয়াতে—এ তত্ত্ব প্রমাণিত করে।
মধ্য এশিয়া ছাড়া ইউরোপীয় পন্ডিতগণ আরো নানা অঞ্চলকে আর্যদের আদি নিবাস বলে বর্ণিত বা কল্পিত করেছেন। এই বিষয় নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই।১৮৭৬ সালে মমসেন Mommsen ইউফ্রেটিস উপত্যকায় আর্যদের আদিনিবাস বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে অধ্যাপক মায়ার্স হ্যাবল্ড (Harold Peake) ও চাহল্ড (D. Childe) প্রভৃতি মনে করেন তুলণামূলক ভাষাতত্ত্ব ও তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অনুসারে আর্যদের আদি নিবাস ছিল খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে দক্ষিণ রুশিয়া ও পূর্বাঞ্চলের কাস্পিয়ান সাগর তীরে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাতত্ত্ববিদ হুইটনি উল্লেখ করেছেন যে আর্যদের আদিম বাসস্থান সম্পর্কে পৌরাণিক উপাখ্যান। ইতিহাস বা ভাষা আলোচনা দ্বারা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কোন পথ নেই। অতএব মধ্য এশিয়ার আর্যদের আদিম বাসস্থান নিরূপণ করা নিতান্তই কল্পনা মাত্র।
ডঃ আইজ্যাক টেলর তার Origin of the Aryans গ্রন্থে “আর্যজাতিকে এক অর্ধ-যাযাবর জাতি যাদের উপ জীবিকা কৃষি ও পশুপালন তাদের জীবিকার জন্য পশু চরাবার জন্য নিশ্চয় বিশাল এলাকার প্রয়োজন ছিল।” মধ্য এশিয়া এক তাতার পরিবারের ৩০০শত গো-মহিষ চরাবার জন্য প্রয়োজন হয় ৩০০০ একর জমি। সুতরাং ১০,০০০ মানুষ সম্বলিত একটি জাতি গোষ্ঠী নিশ্চয়ই ৪০০০ থেকে ৬০০০ বর্গমাইল দখল করে থাকে। এই হিসাবে তাঁর মতে মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি—কাস্পিয়ান সাগর থেকে বলখাস হ্রদ অতিক্রম করে হাজার হাজার মাইল জুড়ে যে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি আছে তাই আর্যদর আদিনিবাস হবার যোগ্যতা রাখে। ডঃ টেলর এর মতে ইয়োরোপে আর্যদের আদিনিবাস হতে পারে না।
ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী নেতা তিলক তাঁর (Artie Home in the Vedas) আর্যদের আদি নিবাস-বেদ সমূহে” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন আর্যদের আদি নিবাস ছিল উত্তর মেরুতে। ভারত ঐতিহ্যবাহী (পুরাণ) গ্রন্থ সমূহে এক মহা প্রলয়ের কথা উল্লেখ আছে। এই প্রলয়ের সময় সর্ব শ্রেষ্ঠ মানুষদের ঈশ্বর আশ্রয় দিয়েছিলেন উত্তর মেরু অঞ্চলে। এই কল্পনা জাত মতবাদকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে আর্যদের আদি নিবাসের কথা উল্লেখ করেছেন।
ইউরোপীয় পন্ডিতগণ যেমন ভাষাতত্ত্ব বিচারে আর্যদের আদি বাসভূমি নিরূপণে অগ্রসর হয়েছিলেন তেমনি নৃতত্ত্ববিদগণও মানুষেও দৈহিক আকৃতি বিচারে চোখ, মুখ, কান, করোটি, চোয়াল দেহের রং ও চুল প্রভৃতির বৈশিষ্ট্য বিচারেই এক বিশিষ্ট জাতি গোষ্ঠী গঠিত—এই মতবাদ প্রচার করেন। এই জাতি গোষ্ঠী গুলির মধ্যে ককেশীয় বা নর্ডিক নরগোষ্ঠীকেহ তারা আর্য নামে পরিচিত করেছেন। এই নরগোষ্ঠীগণের অধিক সংখ্যায় পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে।
তবে আর্যগণ তথাকথিত আদি বাসভূমি থেকে সকলেই কি একই সময় কালের মধ্যে নানা দিক ছরিয়ে পড়েছিল? যদি কিছু সংখ্যকও তাদের আদিম নিবাস আঁকড়ে পড়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই তারা তাদের আদিম ভাষার বিশুদ্ধতা বজায় রেখে কালক্রমে আরও উন্নত হয়েছিল কিন্তু তন্ন তন্ন করে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়েও মধ্য এশিয়া বা দক্ষিণ রাশিয়ার কোথাও কোন নিদর্শন আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয় নাই। অন্যদিকে আর্যগণের আদিম নিবাসতত্ত্বে বিশ্বাসী ইউরোপীয় গবেষকগণ অধিকাংশই ধরে নিয়েছিলেন যে আর্যগণ ভারতে প্রবেশ করে সম্ভবত ২৫০০-১২০০ খ্রীষ্টপূর্ব কালে। দ্বিতীয়ত মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া অথবা ইউরোপের কোন না কোন অঞ্চলে আর্যদের আদিম নিবাস ছিল তা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে অসারতায় প্রতিপন্ন হয়েছে। তৃতীয়ত বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ভাগে এশিয়া মাইনরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে যে সকল নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে তার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্যান ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ঐ অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার ওপর ভারতীয় আর্য সভ্যতার প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব পনেরো শতাব্দীতে। এশিয়া মাইনরে বৈদিক দেবদেবীগণ পূজিত হতেন। এই আবিষ্কার যুগান্তকারী বলা যেতে পারেন। ১৯০৯ সালে ক্যাপাডোসিয়া অঞ্চলে খনন করে প্রত্নতত্ত্ববিদ হুগো ( Hugo Kilneklar) সুপ্রাচীন ‘বোমাসকই’ শহরে একটি মৃত্তিকা ফলক আবিষ্কার করেন। এই ফলকে মিতান্নি রাজ কর্তৃক সকির শর্ত গুলির উল্লেখ আছে এবং আর্যদেবতা বরুন, ইন্দ্র, মিত্রের কাছে সাহায্যের প্রার্থনার উল্লেখ আছে। এই দেবতারা সম্পূর্ণ ভাবেই ভারতীয় দেবতা। এর থেকে মনে হয় এই অঞ্চলেই আর্যরা আগে বসবাস করত পরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেছিল।
পরিশেষে উল্লেখ করা যেতে পারে আজও ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হয় নাই।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .