Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিকাশ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখ।

প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার বিকাশ

অথবা। ঋক-বৈদিক যুগে বর্ণভেদ প্রথা না হলেও বর্ণগুলির সৃষ্টি হয়েছিল কেন?

বর্ণ প্রথার সৃষ্টি

ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, আর্যরা যখন সকলে একত্রে তাদের আদি বাসস্থানে বসবাস করত তখন তাদের মধ্যে পুরোহিত, যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ এই তিন পৃথক্ শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয় আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এই তিন শ্রেণীর মানুষের উল্লেখ আছে।

আর্যদের ভারতে প্রবেশ করার পর থেকেই পরাজিত দাস ও বিজয়ী আর্য এই দু-শ্রেণীতে আর্যসমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজে আর্যবর্ণ ও দাসবর্ণের সৃষ্টি হয়। বৈদিক যুগে দেহের রঙ বা বর্ণের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক শ্রেণীভেদ শুরু হয়। আবার কেউ কেউ বলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পরিধেয় পোষাকের রঙ থেকে বর্ণ কথাটি গ্রহণ করা হয়। যেমন, যারা সাদা বস্ত্র পরতো তাঁরা ছিল ব্রাহ্মণ, লাল বস্তু যারা পরতো তাঁরা ছিল। ক্ষত্রিয়, হলুদ বস্ত্র যারা পরতো তারা ছিল বৈদ্য, আর শূদ্রদের জন্য কালো রঙের বস্ত্র পরা আবশ্যিক ছিল।

ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ

বৈদিক সমাজে জাতিভেদ প্রথা কিভাবে দেখা দেয় তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অধ্যাপক শ্যাম শাস্ত্রীর মতে আহার ও বিবাহের ওপর ভিত্তি করে যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা গড়ে ওঠে তাকেই জাতি (Caste) বলা হয়। প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণীর নাম ছিল, জাতির নয়। অধ্যাপক সেনফিল্ড মনে করেন বৃত্তিগত যোগ্যতা অর্জনই জাতিভেদ প্রথা গড়ে ওঠার কারণ। প্রাচীনকালে বৃত্তিগুলির শ্রেণীবিন্যাস করা হতো শিকার, পশুপালন, কৃষি, দৈহিক শ্রম, ব্যবসা, যজন-যাজন ইত্যাদি। গোপালকৃষ্ণ গোখলেরু মতে বর্ণ ও জন্ম এ দুটি কথা দিয়েই জাতিভেদ প্রথা বর্ণনা করা যায়। বর্ণ কথাটি দিয়ে জাতিগত পার্থক্য বোঝায় এবং জন্ম কথাটি দিয়ে বংশগত গুণাবলীর ইঙ্গিত দেয়। জাতিগত পার্থক্য বোঝাবার জন্য আর্যবর্ণ ও দাসবর্ণ কথা দুটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। ঋগ্‌গ্বেদে ওভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

আর্য ও অনার্য

আর্যরা ভারতের আদিম অধিবাসীদের পরাজিত করে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে পরাজিত ভারতীয়দের নানাদিক থেকে পার্থক্য ছিল। স্বভাবতঃই আর্যরা সমাজে বসবাসকারীদের দু’ভাগে ভাগ করে – আর্য ও অনার্য। রাজনৈতিক দিক থেকে আর্যরা বিজেতা ও অনার্যরা বিজিত ছিল এবং জাতিগত দিক হতে আর্যরা গৌরবর্ণ এবং অনার্যরা কৃষ্ণবর্ণ ছিল।

ঋগবেদে কি বলা হয়েছে

বৈদিক সাহিত্যে অবশ্য জাতিভেদ প্রথার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা ধর্মীয় ব্যাখ্যা। জাতিভেদ প্রথা দৈব-নির্দিষ্ট এটাই যাতে মানা হয় তার জন্য ঋগ্‌বেদের দশম মন্ডলের একটি সূক্তে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র জাতির উৎপত্তির কাহিনী বলা হয়েছে। এই সূক্তে উল্লেখ করা হয় যে, পুরুষ অর্থাৎ স্রষ্টার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের উদ্ভব হয়েছে।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গী

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেও এ বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে বর্ণসমূহের উদ্ভব ঘটেছে দেবাদিদেব ব্রহ্মা থেকে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে যাঁরা এটি বিচার করেছেন তাঁদের মতে জাতিভেদ প্রথার মধ্যে লুপ্তপ্রায় উপজাতি সংগঠনের শেষ চিত্র পাওয়া যায়। জাতিভেদের মধ্যে উপজাতীয় বাঁধনগুলি খুব দৃঢ় ছিল। অর্থাৎ বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা না থাকলেও বর্ণভেদ ছিল।

আধুনিক মত

অধ্যাপক কৌশন্বীর মতে আদি বৈদিক যুগে উপজাতিদের মধ্যে জাতি বা শ্রেণীবৈষম্য ছিল না। কারিগরেরা তখন উপজাতির স্বাধীন সদস্যরূপে গণ্য হত। পরবর্তীকালে যখন উপজাতিগুলি মুছে গেল তখনই দেখা দেয় জাতিভেদ প্রথা। আর্য উপজাতিগুলি উত্তর-ভারতে প্রবেশ করার সময় যে সব আদিবাসীদের সম্মুখীন হয়েছিল। তাদের রীতিনীতি জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মত হ’ল ভারতে আর্য সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জটিলতা আসে এবং পরবর্তী বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। আদি বৈদিক যুগের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর এবং জীবিকার প্রথা ব্যাপকভাবে দেখা দেয়।

বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা

আদি বৈদিক যুগের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর এবং জীবিকার লোক ছিল, কিন্তু কোন শ্রেণী বংশানুক্রমিক ছিল না। সব শ্রেণীর মানুষ এইসব শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। সে কারণে এক বর্ণের লোকেদের সঙ্গে অন্য বর্ণের লোকেদের বিবাহ ও আহারাদিতে বাধা ছিল না। উপযুক্ত গুণের অধিকারী হ’লে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নিজ নিজ বৃত্তি পরিত্যাগ করে অন্য বৃত্তি গ্রহণ করতে পারত। পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয় বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও ঋষিশ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন। মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাস ছিলেন জেলের ছেলে। ঋষি পরাশর চন্ডাল হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঋগ্‌গ্বেদের একটি সূক্তের রচয়িতা বলেছেন : “আমি সূক্তের রচয়িতা, আমার পিতা একজন চিকিৎসক এবং আমার মা যাঁতায় শস্য ভাঙেন। আমরা পৃথক পৃথক কাজ করে থাকি।”

কিন্তু ক্রমে আর্যসমাজে জটিলতা বেড়ে যায় এবং বর্ণভেদ প্রথা তীব্র হয় এবং এক শ্রেণী থেকে অপর শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বর্ণভেদ প্রথাকে জন্মগত বলে মনে করা হতে থাকে। ফলে গুণ ও কর্ম অনুসারে যে শ্রেণীভেদ সমাজে গড়ে উঠেছিল তা লোপ পায়।

Leave a reply