প্রাচীন ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য
সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। হরপ্পা ও সিন্ধু সভ্যতার আমলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায়। তারপর মৌর্য ও মৌর্য পরবর্তী যুগে এই সম্পর্কের আরও বিস্তার ঘটে যা ভারতের তুর্কি অভিযানের সমকালীন যুগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকে।
(১) বহির্বিশ্বের সঙ্গে হরপ্পা ও সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগাযোগ
সিন্ধু সভ্যতার যুগেও জলপথ ও স্থলপথে মানবজাতির গমনাগমন ছিল। সুতরাং বলা যায় মিশরীয় ও আসিরীয়-ব্যবিলনীয় সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার যোগাযোগ ছিল। মেসোপটেমিয়া ও মহেঞ্জোদাড়োর সীলমোহরগুলির মধ্যে বেশ মিল দেখা যায়। সুমার অঞ্চলের সীলমোহর, দীপাধার ও খোদাই করা পাত্র মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পায় পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, জলপথে মিশর ও স্থলপথে বেলুচিস্তান ও সুমেরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সিন্ধুবাসীদের বাণিজ্যের চলাচল ছিল। ঐতিহাসিক চাইল্ড (Child)-এর মতে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর শিল্পীরা তাদের পণ্যসম্ভার নিয়ে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদের উপকূলে অবস্থিত বাজারে যাতায়াত করত। পশ্চিম এশিয়ার ‘আক্কাদ’ অঞ্চলে ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশেরও অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে হরপ্পার বণিকদের প্রধান বাণিজ্য-সম্ভার ছিল সুতীর পোশাক-পরিচ্ছদ। সেখান থেকে তারা ভারতে আমদানি করত মূল্যবান পাথর ও কিছু বিশেষ ধরনের কাঁচামাল।
(২) মৌর্যযুগের বৈদেশিক বাণিজ্য
মৌর্যযুগেও বৈদেশিক বাণিজ্য উন্নত ছিল। আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর থেকে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার গ্রীকরাজ্যগুলির সঙ্গে মৌর্যরাজাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। এর ফলে বিদেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক দ্রুত বেড়ে যায়। স্থলপথ ও জলপথ দিয়েই এই বাণিজ্য চলত। জলপথে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলি থেকে ভারতে পণ্যবাহী জাহাজ আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের ওপর দিয় পশ্চিম এশিয়া থেকে মিশবে আসতো। অন্যদিকে স্থলপথেও পারস্য ও এশিয়া মাইনরের ভিতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য ভূমধ্যসাগরে পাঠানো হত। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে ভারত ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এছাড়া এই সময় চীন, গ্রীস, সিংহল (বর্তমানে শ্রীলংকা) প্রভৃতি দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পশ্চিম এশিয়া থেকে মৌর্য রাজারা মিষ্টি, মদ ও শুকনো ডুমুর আমদানি করতেন। এর বিনিময়ে পশ্চিম এশিয়ার বণিকরা ভারত থেকে বিলাস সামগ্রী ও মসলিন বস্ত্র রপ্তানি করত।
মৌর্যোত্তর যুগের বৈদেশিক বাণিজ্য
মৌর্যোত্তর যুগে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় এবং তা হল ব্যবসা-বাণিজ্য। দীর্ঘ ও প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণ করে এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে একই ধরনের শাসনব্যবস্থার প্রচলন করে মৌর্য সাম্রাজ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করেছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অভারতীয়দের প্রতিপত্তি ভারতীয় বণিকদের সুবিধা করে দিয়েছিল। পল্লব ও কুষাণরা মধ্য-এশিয়ার ভিতর দিয়ে স্থলপথে চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়। মশলা ও বিলাস সামগ্রীর জন্য রোমের চাহিদা মেটাতে ভারতীয় বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতে প্রলুব্ধ করেছিল। রোম থেকে সোনা, রূপা ও চীনামাটির বাসন ভারতে আমদানি করা হত। অন্যদিকে ভারত থেকে মসলিন ও সূতীবস্ত্র রোমে রপ্তানি করা হত। ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে রোম ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কও ঘনিষ্ট হয়।
সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য
সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছাড়াও বহির্বাণিজ্যও খুবই সমৃদ্ধ ছিল। বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারে চোল রাজারা ছিলেন খুবই তৎপর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চোলরা আরবদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে এবং এই বাণিজ্য দখল করার জন্য সমগ্র মালাবারে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিতিষ্ঠিত করে। দশম শতকে চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-ভারতের যথেষ্ট বাণিজ্যক লেনদেন ছিল। দক্ষিণ-ভারত থেকে চীনে সুতীবস্ত্র, মশলা, মণিমুক্তা, হাতির দাঁত প্রভৃতি রপ্তানি করা হত। মহাবলীপুরম, কারেরীপট্টনম, কুইলন প্রভৃতি দক্ষিণী বন্দরগুলি থেকেই প্রধানত বহির্বাণিজ্যের চলাচল হত। দক্ষিণ-ভারতের মন্দিরগুলিও ব্যবসা-বাণিজ্যে সক্রিয় অংশ নিত।
এই সময়ে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল প্রধানত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক। কিন্তু মধ্য-এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতীয়রা বাণিজ্যের সূত্র ধরে রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপন করেছিল। ভারতীয় বণিকরা পণ্যসম্ভার নিয়ে স্থলপথে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ব্যাকট্রিয়ার আসত। সে-সময় ব্যাকট্রিয়া ছিল ভারত, চীন ও পশ্চিমী দেশগুলির মিলন কেন্দ্র। সেখান থেকে অক্ষুনদীর অববাহিকা ধরে জলপথে কাস্পিয়ান সাগরের বন্দরগুলিতে ভারতীয় পণসম্ভার নিয়ে যাওয়া হত। পূর্বদিকে স্থলপথে পামীর উপত্যকা ও গোবি মরুভূমির ওপর দিয়ে পণ্যসম্ভার নিয়ে যাওয়া হত।
এই যুগে চীনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। চীনা জাহাজগুলি সাধারণত মালাক্কা পর্যন্ত আসত। চীন ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী স্থলপথগুলো নিরাপদ না থাকায় সমুদ্রপথেই যোগাযোগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। চীনের বহির্বাণিজ্যের প্রধান সমুদ্র বন্দর ছিল ক্যান্টন। ভারতীয় রাজারা, বিশেষ করে বাংলাদেশের পাল ও সেন রাজারা এবং দক্ষিণ-ভারতের পল্লব ও চোল রাজারা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য চীনা সম্রাটের কাছে দূত পাঠাতেন। চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে মালয় ও তার প্রতিবেশী দেশগুলি। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য চোলরাজ প্রথম রাজেন্দ্র ঐসব দেশের বিরুদ্ধে বিরাট নৌ-অভিযান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরব ও চীনাদের জাহাজের সঙ্গে ভারতীয় জাহাজ পাল্লা দিতে ব্যর্থ হলে ভারতীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা নেমে আসে।
প্রাচীনকালেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়, ইন্দোচীন, সুমাত্রা, যবদ্বীপ, জাভা প্রভৃতি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলটি ভারতবাসীর কাছে সুবর্ণভূমি নামে সুপরিচিত ছিল। ভারতীয় বণিকরা সমুদ্রপথে এইসব দেশে পণ্যসম্ভার নিয়ে যাওয়া আসা করত। তাম্রলিপ্ত ও ভৃগুচ্ছ প্রভৃতি বন্দর থেকেই ভারতীয়রা সমুদ্রপথে এইসব দেশে যাতায়াত করত। খ্রীষ্টীয় চৌদ্দ শতকের জাভার এক লেখক লিখেছেন যে, সে-সময় বড় বড় জাহাজে করে জম্বুদ্বীপ, কর্ণাটক এবং গৌড় থেকে বহু মানুষ এইসব দ্বীপে সবসময়ে আসা যাওয়া করত। ‘বৃহৎ কথা কোষ’ নামক প্রাচীন-গ্রন্থে ভারতীয়দের সামুদ্রিক বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .