Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য

রাজার ক্ষমতা

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থায় আপাতঃ দৃষ্টিতে রাজা ছিলেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। সেনাদল, কর্মচারীবৃন্দ তাঁরই নির্দেশে চলত। তিনি তাদের নিয়োগ করতেন এবং তাদের আনুগত্য ভোগ করতেন। রাজ্য শাসনের কাজে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজাকে নিতে হত। প্রাদশিক কর্মচারীরাও তাঁর দ্বারা নিযুক্ত হত এবং তাঁকে আনুগত্য দিত। তিনি ছিলেন রাজ্যের সর্বপ্রধান বিচারক। তিনি বংশানুক্রমিক অধিকারে শাসন করতেন।

রাজার উপাধি

গুপ্ত সম্রাটরা তাঁদের এই উচ্চ ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আড়ম্বরপূর্ণ উপাধি নেন। যে ক্ষেত্রে মৌর্য সম্রাটরা কেবলমাত্র ‘দেবতাদের প্রিয’ এই উপাধি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন, সে ক্ষেত্রে গুপ্তরা নিজেদের ঐশ্বরিক গুণযুক্ত, ঈশ্বরের অংশ বলে দাবী করতেন। তাঁরা নিজেদের “পরমদৈবত”, “লোকধাম-দেব” ইন্দ্র, বরুণ, কুবেরের সমান বলে দাবী করতেন। রাজপদ বংশানুক্রমিক হলেও কখনও কখনও সম্রাট তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের স্থলে অন্য পুত্রকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করতেন।

রাজার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা

১) গুপ্ত সম্রাটরা তাত্ত্বিক দিক থেকে অপরিসীম ক্ষমতা দাবী করলেও, হাতে কলমে তাঁদের ক্ষমতা বেশী ছিল না। মৌর্য সম্রাটদের তুলনায় গুপ্ত সম্রাটদের ক্ষমতা ছিল বাস্তবে সীমিত। রাজা নিজেকে দেবতার সমকক্ষ বলে দাবী করলেও বাস্তবে তাঁকে বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হত। সামন্ত শক্তি রাজ ক্ষমতাকে কোণঠাসা করেছিল। রাজাকে দেশ শাসন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্যে সামন্তদের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হত। স্মৃতি শাস্ত্রগুলিতে আর মৌর্য যুগের মত রাজাকে দেবতার সৃষ্টি মনে করা হত না। দেবতার মত রাজা অভ্রান্ত একথাও ভাবা হত না। তবে স্মৃতি শাস্ত্র রাজাকে সম্মান জানাতে বলত।

২) মৌর্য যুগে শাসন ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীভূত। একটি গ্রামে বা জেলায় কি ঘটছে, অশোক তাঁর গুপ্তচরদের দ্বারা তা জেনে নিতেন। কিন্তু গুপ্ত যুগে শাসন ব্যবস্থা ছিল বিকেন্দ্রীভূত। প্রদেশ ও বিষয় বা জেলা স্তরে প্রায় স্বায়ত্ব শাসন চলত। কেন্দ্রের মূলনীতির বিরোধিতা না করলে, প্রদেশের ও জেলার শাসনকর্তা বহু ক্ষমতা ভোগ করতে পারতেন।

৩) গুপ্ত যুগে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বৈদেশিক আক্রমণ চলার ফলে রাজার স্বৈর ক্ষমতা কার্যকরী হতে পারেনি। তাঁকে যুদ্ধের প্রয়োজনে স্থানীয় সামন্ত ও প্রাদেশিক শাসকদের ওপর বহু পরিমাণে নির্ভর করতে হত।

৪) রাজা ইচ্ছামত আইন তৈরি করতে পারতেন না। তাঁকে চিরাচরিত প্রথা, ধর্ম শাস্ত্র, ব্রাহ্মণদের বিধান মেনে চলতে হত।

৫) মন্ত্রী পদ ছিল বংশানুক্রমিক। ফলে মন্ত্রীরা রাজার সঙ্গে অনেকটা ক্ষমতা ভাগ করে নিতেন।

৬) বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসারে গ্রাম ও বিষয়গুলির শাসন স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাহায্যে কর্মচারীরা চালাত। এর ফলে রাজা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তেমন পেতেন না।

৭) গুপ্ত যুগে গ্রামগুলি স্বয়ম্ভর ছিল। ফলে বাড়তি উৎপাদন না করে গ্রামের প্রয়োজন-মাফিক লোকে উৎপাদন করত। এজন্য বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। গুপ্ত সম্রাটরা কর্মচারীদের বেতন না দিতে পেরে জমি বা জাগীর দেন। কর্মচারীরা জমিতে অধিকার পেলে তারা খুবই শক্তিশালী হয়ে পড়ে। রাজার পক্ষে সর্বদা তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না।

৮) রাজা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। অন্যায় কাজ করলে তাঁর বিরুদ্ধে জনসাধারণ বিদ্রোহ করতে পারত।

৯) রাজার মত মন্ত্রীরাও ছিলেন বংশানুক্রমিক। মন্ত্রী ও অমাত্যরা রাজার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতেন। এই সকল কারণে অনেকে বলেন যে, গুপ্ত যুগে রাজার ক্ষমতা মৌর্য যুগের তুলনায় দুর্বল ছিল।

কেন্দ্রীয় প্রশাসন

কেন্দ্রে রাজাকে শাসনের কাজে সাহায্যের জন্যে মন্ত্রী, যুবরাজ ও উচ্চ কর্মচারীরা ছিল। গুপ্ত যুগে মন্ত্রীরা এককভাবে রাজাকে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সাহায্য দিত। কিন্তু মৌর্য যুগের মত কোন মন্ত্রী পরিষদ গুপ্তযুগে ছিল না। কারও কারও মতে, মনুসংহিতায় মন্ত্রী পরিষদের আভাষ পাওয়া যায়। মন্ত্রী পদ এই যুগে বংশানুক্রমিক ছিল। উদয়গিরি গুহালিপি থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেনের পিতাও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নিজেকে “অন্বয় প্রাপ্ত সচিব্য” বলেছেন।

বিভিন্ন বর্গের কেন্দ্রীয় কর্মচারী

গুপ্ত সম্রাটরা কেন্দ্রে বহু কর্মচারী নিয়োগ করতেন। মহাবলাধিকৃত ছিলেন সেনাপ্রধান। তাঁর অধীনে বিভিন্ন সামরিক পদ যথা, অশ্ব বাহিনীর প্রধান বা মহাশ্বপতি, হস্তীবাহিনীর প্রধান মহাপীলুপতি প্রভৃতি থাকত। মহাদণ্ডনায়ক সম্ভবতঃ প্রধান সেনাপতি বা রক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মহাপ্রতীহার ছিলেন রাজপ্রাসাদের রক্ষী বাহিনীর প্রধান। সহি-বিগ্রহিক নামে একটি নতুন পদের কথা জানা যায়। এই কর্মচারী রাজাকে বৈদেশিক ব্যাপার, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতির বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। হরিষেণ ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের সন্ধি-বিগ্রাহিক। অক্ষ-পটলাধিকৃত নামে কর্মচারী সরকারী দলিলপত্র রচনা ও রক্ষা করতেন। এঁদের নীচে আরও নিম্নবর্গের কর্মচারী ছিল— যথা করণিক বা কেরাণী, দৌবারিক বা দরওয়ান প্রভৃতি। গুপ্ত যুগে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের সংযোগ রাখার জন্যে কুমারমাতা ও আযুক্ত নামে কর্মচারী নিযুক্ত হত। সাধারণত দু ধরণের কুমারমাতা ছিলেন। পরমভট্টারক স্থানীয় কুমার মাত্যরা সম্রাটের কাজে নিযুক্ত হত। অন্য কুমারমাত্যরা যুবরাজের কাজ করত।

প্রাদেশিক শাসন বিভাজন

গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে শাসন করা হত। এযুগে প্রদেশগুলির নাম ছিল দেশ বা ভুক্তি অথবা ভোগ। সাধারণতঃ গাঙ্গেয় উপত্যকার প্রদেশগুলিকে ভুক্তি বলা হত— যথা তীরভুক্তি বা ত্রিহুত, পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি, শ্রাবন্তীভুক্তি, অহিচ্ছত্রভুক্তি। দেশ নামধারী অঙ্কুর ছিল পশ্চিমভারতে যথা, সৌরাষ্ট্র দেশ, সুকুলি দেশ। গোপ্ত উপাধিধারী কর্মচারীরা দেশ শাসন করত, ভূক্তির শাসকের উপাধি ছিল উপারিক। কখনও কখনও রাজপরিবারের লোকেরা উপারিকের পদে কাজ করত। দামোদরপুর লিপি থেকে পুণ্ড্রবর্ধনের উপারিক মহারাজপুত্র দেবভট্টারকের নাম শোনা যায়। ভুক্তিগুলিকে জেলা বা বিষয়ে ভাগ করা হত। গুপ্ত প্রাদেশিক শাসনে বিষয় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এরকম অনেকগুলি বিষয় বা জেলার নাম জানা যায়, যথা কোটিবর্ষ বিষয় বা দিনাজপুর জেলা, অন্তর্বেদী বিষয় বা দোয়াব জেলা প্রভৃতি বিষয়ের শাসনের জন্যে কুমারমাত্য, বিষয়াপতি, আযুক্ত প্রভৃতি কর্মচারীরা নিযুক্ত হত।

বিষয় শাসন

বিষয়ের শাসনকর্তা সাধারণতঃ প্রাদেশিক শাসনকর্তার দ্বারাই নিযুক্ত হত। তবে ইন্দোর লিপি থেকে জানা যায় যে, কখনও কখনও সম্রাট সরাসরি বিষয়ের শাসককে নিযুক্ত করতেন। অন্তর্বেদী বা দোয়াব বিষয়ের শাসনকর্তা সর্বনাগ ছিলেন সম্রাটের প্রত্যক্ষ নিয়েন্ত্রণে। দামোদরপুর লিপি থেকে জানা যায় যে, সাধারণতঃ উপারিকরাই বিষয়পতিদের নিয়ন্ত্রণ করত।

নির্বাচিত পরিষদ

গুপ্ত যুগে বিষয়ের শাসনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটান হয়। বিষয়ের শাসন কাজে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অধিকরণ বা পরিষদ নামে একটি সভা থাকত। এই পরিষদের নাম ছিল অধিষ্ঠান-অধিকরণ। এই পরিষদ বা সভায় বিভিন্ন শ্রেনীর স্থানীয় প্রধান, প্রথম কুলিক বা প্রধান কারিগর প্রভৃতি নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হত। এরা পদাধিকার বলে সদস্য হত। গ্রামের শাসনের ক্ষেত্রেও গুপ্ত যুগে প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়ার নিয় প্রবর্তন করা হয়।

গ্রামীন শাসন

গুপ্তযুগে গ্রামের শাসন ব্যবস্থায় গ্রামিকরা সরকারী কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। গ্রামের প্রধান বা মোড়লকে বলা হত মহত্তর বা ভোজক। এই ব্যক্তি গ্রাম শাসনে গ্রামিককে সাহায্য করত। গ্রামসভা বা মহাসভার সাহায্যে গ্রামিকরা পতিত জমি, কর্ষিত জমির আলাদা তালিকা করত, জমি মাপ করত, পথ ঘাট, বাজার, মন্দির, পুষ্করিণী প্রভৃতির পরিচালনার ব্যবস্থা করত।

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা ছিল বিকেন্দ্রকরণ এবং উদারমানবিক প্রশাসনিক শাসনব্যবস্থা। যার ফলে গুপ্তশাসকরা বিশাল ভারত দীর্ঘদিন সু-শাসন বজায় রাখতে পেরেছিল।

Leave a reply