প্রাচীন ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের সংগঠনে গিল্ডের ভূমিকা
প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য এবং শিল্প দুই-ই সুসংগঠিত ছিল। তাদের এই সংগঠন শক্তি যে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল তাকে বলা হত শ্রেণী বা গিল্ড। প্রাচীন সাহিত্যে প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত “গণ”, “পূগ” এবং যঙ্গ ও নৈগম শব্দগুলি পাওয়া যায়। গিল্ড গঠনের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল শিল্পের স্থানীয়করণ। ডঃ ফিক মনে করেন যে বংশানুক্রম, স্থানীয়করণ এবং জেথথিক পদ এর উপস্থিতি দেখে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে প্রাচীন ভারতে এমন একটি সংস্থা ছিল যা মধ্যযুগের ইউরোপের গিল্ডের সঙ্গে তুলনীয়। ধীরে ধীরে গিল্ডের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল। গিল্ড প্রসঙ্গ ডঃ বাসাম বলেছেন যে উন্নত শ্রেণীর কারিগর গিল্ডে মিলিত ভাবে থেকে যে আত্মসম্মান বোধ লাভ করত, তা আর অন্য কোন ভাবে পেতে পারত না। অন্যদিকে রাষ্ট্রের দিক থেকে গিল্ডের মাধ্যমে কর আদায়ের এবং শিল্প পরিচালনার সুবিধা হত। ভারতীয় ঐতিহ্য, সাহিত্য এবং ধর্মসূত্রগুলি গিল্ডকে সমর্থন করেছে এবং গিল্ডের বিভিন্ন রীতিনীতি বা প্রথাকে আইনের মর্যাদা দিয়েছে। রাষ্ট্র ও গিল্ডের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছে। এর ফলে জাতিগত এবং স্থানগত বিভেদ অতিক্রম করে এবং উত্তীর্ণ হয়ে গিল্ড ধীরে ধীরে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
গিল্ডগুলি অভ্যন্তরীণ সংগঠনে তাদের স্বাধিকার অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। গিল্ডের বিধান এ যুগের সরকার মেনে চলত। বিভিন্ন গিল্ডের যৌথ বৃহত্তর সংস্থায় এই বিধানগুলি রচিত হত। এই বৃহত্তর সংস্থার একজন সভাপতি থাকতেন এবং নির্বাচিত উপদেষ্টামন্ডলী থাকত। এদের সংখ্যা ৩-৫ জন হত। সৎ ও ধার্মিক ব্যক্তিরাই সাধারণত নির্বাচিত হতেন। তবে কে উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্যদেরকে নিযুক্ত করতেন তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না।
গিল্ডের দায়িত্ব
তৎকালীন লেখ থেকে জানা যায় যে গিল্ড ব্যক্তি বিশেষ এমন কি রাষ্ট্রের সরকারের সাথেও চুক্তিবদ্ধ হত বাণিজ্যিক ব্যাপারে। এছাড়াও ব্যক্তি বিশেষের নিকট হতে গিল্ড অর্থ ঋণ নিত এবং পরে তা সুদ সহ শোধ করত। এইভাবে গিল্ডের মাধ্যমে কারিগর এবং ক্রেতা উভয়েরই স্বার্থ সংরক্ষিত হত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য গিল্ডের দানের নানা উল্লেখ বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যে দেখতে পাওয়া যায়। উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য গিল্ড অনেক সময় ভাড়াটে শ্রমিক ও ক্রীতদাসদের নিযুক্ত করত। কারিগর পুত্রদের প্রযুক্তি বিদ্যা শেখানোর সক্রিয় ভূমিকা ছিল গিল্ডের। গিল্ডের নেতৃবৃন্দ তৎকালীন নাগরিক জীবনে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন কিন্তু তাদের রাজনৈতিক উচ্চাশার কোন চিহ্ন কোন লেখতে পাওয়া যায় না। সংঘগুলির কাজের নানারকম নিয়ম কানুন ছিল। ক্রেতা ও কারিগর উভয়ের সুবিধানুযায়ী সামগ্রীর উৎকর্ষ অনুসারে দাম স্থির করে দেওয়া হত। বিচার সভার মাধ্যমে সমবায় সংঘের সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হত। সংঘের প্রচলিত প্রথাও গুরুত্ব ছিল আইনের মতোই। সভ্যদের পারিবারিক জীবনেও যে সংঘগুলি হস্তক্ষেপ করত তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই নিয়মটি থেকে যে কোনো বিবাহিতা মহিলা বৌদ্ধ-ভিক্ষুণী হতে চেলে তাকে কেবল স্বামী নয়, স্বামী যে সংঘের সদস্য তারও অনুমতি নিতে হত।
জাতিপ্রথার ফলে সমবায় সংঘগুলির কোন সময় সদস্যের অভাব হত না। কেননা বর্ণপ্রথা অনুসারে এক এক বর্ণ বা উপবর্ণের লোকেরা পুরুষানুক্রমে একই শিল্পের চর্চা করে যেত। শ্রেণী ছাড়াও কারিগরদের অন্য ধরণের সমবায় সংঘও ছিল বিভিন্ন শিল্পের কারিগররা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যেও সংঘ গঠন করত। যেমন কোন স্থাপত্য যথা মন্দির বা বাড়ি তৈরীর কাজে যেসব সংঘগুলির সদস্যদের মধ্যে স্থপতি, যন্ত্রবিদ, রাজমিস্ত্রী প্রভৃতি ধরণের লোক থাকত—তারা ঐ কাজের ভার পেত।
খনন কার্যের ফলে বহু সংঘের নাম খোদিত শিলমোহর পাওয়া গেছে। উৎসবের সময় সংঘগুলি নিজস্ব চিহ্ন ও পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোত। সংঘগুলি বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থাকে যথেষ্ট, অর্থদান করত। বিদিশার হাতির দাঁতের কারিগরদের সংঘ সাঁচীস্তূপের তোরণ তৈরীর কাজ করেছিল। নাসিকে প্রাপ্ত শক রাজাদের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে একটি তন্তুবায় সংঘ একটি বিহারকে কিছু অর্থ দান করে। ঐ অর্থ খাটিয়ে সুদ আদায় করে বিহারের খরচ চলত। কোন কোন সময় সংঘগুলি ব্যাঙ্ক ও ট্রাস্টির কাজও করত। তবে সাধারণমত বিশেষ কিছু ব্যবসায়ীই এই কাজ করত। তাদের বলা হত “শ্রেষ্ঠী”। দক্ষিণ ভারতে এরা চেট্টিয়া বা চেট্টি নামে পরিচিত হত। এরাই সাধারণত ব্যাঙ্কিং এর কাজকর্ম পরিচালনা করত। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় টাকার ভূমিকা বৃদ্ধি পেলে ব্যাঙ্কের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্যাঙ্কের কাজকর্মের মধ্যে তেজারতি কারবারও ছিল। সুদ নেওয়া হত সাধারণত শতকরা ১৫ হিসাবে। সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য টাকা ধার দিলে তার সুদের হার বেশী হত।
পেশাদারী গিল্ড গুলি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি যখন সংশ্লিষ্ট কোন শ্রেণীর সদস্যপদ পেতে চাইতেন তখন তাকে চারটি পর্যায়ের ভিতর দিয়ে যেতে হত।
১। “কোষ”–চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জন্য শুদ্ধিজাতীয় পরীক্ষা
২। লেখক্রিয়া শ্রেণীর নিয়মাবলী মানার ব্যাপারে লিখিত প্রতিজ্ঞা
৩। মধ্যস্থ—নতুন সদস্যকে উত্তমরূপে জানেন এমন কোনও ব্যক্তিকে সাক্ষী থাকতে হত।
“শ্রেণীর” সদস্যদের ভিতর পারস্পরিক বিশ্বাস থাকা যে অপরিহার্য ছিল। এই কথা সম্বতি শাস্ত্রগুলি বার বার উল্লেখ করেছিলেন।
কালক্রমে গিল্ডের প্রভাব ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছিল। সদস্যদের ওপর গিল্ডের প্রভাব আগের মত ছিল না। কারণ গিল্ড ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিয়েছিল, ফলে সদস্যদের স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। যৌথস্বার্থ এতে অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়েছিল। “নারদ স্মৃতি” থেকে অনুমান করা যায় যে পরবর্তী সময় গিল্ডের পরিচালনার ওপর রাজা হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেয়েছিল যা গিল্ডের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছিল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের সাহিত্যে “শ্রেণীকরণের” উল্লেখ আছে। “শ্রেণীকরণ” হল প্রশাসনিক দপ্তর যা গিল্ডগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করত।
প্রাচীনযুগে শ্রেণী (গিল্ড) গুলিতে “জাতি” আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে শ্রেণীকে “জাতি” আখ্যা দিয়ে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন কুম্ভকার, তাঁতি, স্বর্ণকার রজতকার প্রভৃতিকে শুদ্ধ জাতি অন্যদিকে চর্মকার, তেলি, ইক্ষুপীড়ণকারী, রঙ্গকার প্রভৃতিকে অশুভ জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। এইসব কর্ম ভিত্তিক শ্রেণীকে নিয়েই প্রাচীনকালে গিল্ড গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আদি মধ্য যুগের অন্তিম পর্বে এইভাবে। জাতপাত ভিত্তিক বিভক্ত করার ফলে গিল্ডগুলির ঐক্য বিনষ্ট হয়।
সমকালীন লেখমালায় বিশেষ করে গোয়ালিয়র লেখতে ২০ জন তৈলিক প্রধান ও ১৪ জন মালাকার প্রধানের নাম পাওয়া যায়। এছাড়াও সুরা ও পাথরকাটা কারিগরদের সংগঠন ছিল। এই সময়ের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল “শ্রেণীগুলি” এক একটি পরিবারকে আশ্রয় করে গড়ে উঠতে থাকে। এক পেশায় অনেক সংগঠন এবং একাধিক নেতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে শ্রেণী সংগঠনে ভাঙন দেখা দেয়। এই সময় জমিদার বা ভূ-স্বামীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় গিল্ডের শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়েছিল। এর ফলে শিল্প গিল্ডে শ্রমিকে অভাব দেখা দেয়। গিল্ডগুলির ব্যাঙ্কিং অবস্থাও যথেষ্ট গুরুত্ব হারায়। এছাড়াও ঘন ঘন রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও গিল্ডগুলির অস্তিত্বের সংঙ্কট দেখা দেয়। এই ভাবেই ভারতের ঐতিহ্যবাহী গিল্ডগুলির পতনের দিকে ধাবিত হয়েছিল।
এ সত্ত্বেও পরিশেষে ডঃ মজুমদারের মত দিয়েই গিল্ডের মূল্যায়ণ করা একান্ত প্রয়োজন। তার মতে গিল্ড শুধুমাত্র শিল্প ও কারিগরী বিদ্যার উন্নতি বিধানের যন্ত্র স্বরূপ ছিল না। দেশের আইন গিল্ডকে যে স্বাধীনতা দিয়েছিল তার সাহায্যে গিল্ড একসময় শক্তির কেন্দ্র এবং সংস্কৃতি ও প্রগতির একটি আধার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গিল্ড ছিল যুগপৎ সমাজের শক্তি এবং অলঙ্কার।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .