ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যপ্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্য
প্রত্ন্যাশ্মীয় যুগ ও তার পরবর্তী নবাশ্মীর যুগের মধ্যবর্তী একটি পরিবর্তন যুগ। এই যুগটিকে বলা হয় Mesolithic বা মধ্যাশ্মীয় যুগ। পূর্ববর্তী যুগের মত এই যুগের অধিবাসীরাও খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি। তারাও ছিল মুখ্যত শিকারজীবী। কিন্তু হাতিয়ারের ক্ষেত্রে এই মধ্যবর্তী যুগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। মধ্যাশ্মীয় হাতিয়ারগুলি আকারে অতি ক্ষুদ্র, যে কারণে সেগুলির নামকরণ করা হয়েছে ক্ষুদ্রাশ্ম (microlith)। কোন কোন ক্ষেত্রে যা এক ইঞ্চির চেয়েও বড় নয়।
এই জাতীয় বহু ক্ষুদ্রাশ্মীর নিদর্শন পাওয়া গেছে দক্ষিণ ভারতের প্রায় সকল জেলায়, বিশেষ করে টিনেভিলিতে এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কয়েক স্থানে ও তৎসহ গুজরাটে, মধ্যভারতের ছোটনাগপুর। এগুলিও এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস এবং সেই হিসাব কোন নির্দিষ্ট যুগে এগুলিকে নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে অসুবিধা আছে। কোন কোন স্থানে এই ক্ষুদ্রাশ্ম গুলি বেশ আধুনিক যুগের, খৃষ্টপূর্ব চারশো অব্দের কাছাকাছি, তবে অধিকাংশই বেশ প্রাচীন। সাম্প্রতিক কালে খননকার্যের ফলে মহীশূরের ব্রহ্মগিরিতে ও গুজরাটের লংঘনাজের প্রচুর ক্ষুদ্রাশ্ম পাওয়া গেছে যা নিঃসন্দেহে মধ্যাশ্মী যুগের। অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্রাশ্মের কেন্দ্র হিসাবে আমরা পাঁচমারির মহাদেও পাহাড়, পাঞ্জাবের নওসেরার নিকটবর্তী উচালি, উত্তর গুজরাটের হীরাপুর প্রভৃতি স্থানে নাম করতে পারি।
স্মরণ করা যেতে পারে উচ্চ পুরা প্রস্তর উপ-পর্বের মধ্যপ্রস্তর পর্বের উত্তরণে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পন্ডিতগণ মধ্যপ্রস্তর পর্বীয় কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্রের আনুমানিক কাল নির্ধারণ করেছেন। তার মধ্যে রাজস্থানের ভিলওয়ারাজেলার বাগোর এ। এই পর্বের প্রথম পর্যায়ের কালসীমা ৫৪১৮-৪৯৩৬ খ্রীঃ পূর্বাব্দ উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় জেলার সরাই নাহার রাই এর ক্ষুদ্রাশ্মীয় সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল ৮০০০ খ্রী পূর্বাব্দে। মধ্যপ্রদেশের বাঘোর-এ এই সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল খ্রীঃ পূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দে। অন্যদিকে তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে প্রাপ্ত হাতিয়ার এই পর্যায়ের অন্তিম পর্বের বলে অনুমান করা হয়।
নানা দিক আলোচনা বা বিশ্লেষণ করে বলা যায় ভারতের মধ্যপ্রস্তর পর্বের সূচনা হয়েছে ভূ-তাত্ত্বিক অর্থাৎ হলোসিন যুগের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে। আনুমানিক ১০০০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ থেকে এই যুগের সূচনা হয়। এই সময় ববফের যুগের অবসান ঘটে। আবহাওয়া হয়ে ওঠে শুষ্ক। ফলে অনুকূল জলবায়ু জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ সহজ সাধ্য হয়। এই পর্বের মানুষও খাদ্য সংগ্রহ করত। কিন্তু এই সময় খাদ্য সংগ্রহের কাজে মানুষ ছুঁচলো ও ধারালো হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। এর সাথে সাথে এই পর্বে হাতিয়ারের ধরণের বৈচিত্র্য আসে। ধরার সুবিধার জন্য বেশির ভাগ হাতিয়ারের গায়ে হাতল লাগানো হত। এর সাথে সাথে ভেড়া ও ছাগলকে বশে আনতে শুরু করেছিল। গরুকেও পোষ মানানোর কাজে শুরু হয়। শিকারের উপর নির্ভরতা হ্রাস পেতে থাকে। মাংস আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার সূচনা হয় এবং চুল্লি তৈরীর কাজও সূচনা হয়।
উদ্ভিদ জগত থেকেও খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল এই যুগের মানুষরা। উদ্ভিজ্জ সামগ্রী পেষণের জন্য হাতিয়ার ব্যবহার করা হতে থাকে।
এই সময়ের কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে নদী বা জলাশয়ের ধারে লতাপাতার কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করে অস্থায়ী বসতি স্থাপনের সূচনা করে। কালক্রমে পাথরের বেড় দিয়ে কুড়ে ঘরকে সুরক্ষিত করে তোলে ঘর তৈরীর জন্য পাথর এবং খুঁটির ব্যবহারও শুরু হয়।
রাজস্থানের বাগোর বেলান অববাহিকায় কয়েকটি প্রত্নস্থলে সচ্ছিদ্র ভারী পাথরের চাকতি এবং গর্তে বীজ ফেলে ফসল ফলাবার প্রয়াস ও মধ্য প্রস্তর যুগের অন্তিম পর্বে মৃৎপাত্র নির্মাণও শুরু হয়। মহাদহের নরকঙ্কাল বিশ্লেষণ করে দেখে গেছে এদের গড় আয়ু ছিল ১৬-৩৫ বছরের মধ্যে। অনুমান করা হয় শিকারের কাজ করত ছেলেরা ও মেয়েরা ব্যস্ত থাকত খাদ্য ও জ্বালানি সংগ্রহে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভানপুর ক্ষুদ্রাশ্লীয় সংস্কৃতির একটি স্মরণীয় কেন্দ্র। গুজরাতের লাংমনাজ এই পর্বের আর একটি প্রত্নক্ষেত্র। এখানে ২টি ভিন্ন নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে । ভীমবেটকার কিছু কিছু গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। শিকারের ছবিই বেশি। উত্তরপ্রদেশে মিজাপুর, মধ্যপ্রদেশের বান্দা, বিহারের নওয়াদা, এবং ঝাড়খন্ডের হাজারিবাগ অঞ্চলে এই সময়ের গুহা চিত্র পাওয়া গেছে।
মধ্যপ্রস্তর যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনের সে সময়ের মানুষ মারা গেলে তাকে বসতির মধ্যেই কবর দেওয়া হত। একক কররের যেমন নিদর্শন আছে তেমনি একসঙ্গে চারজন লোককে কবর দেওয়ার নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে পরিশেষে বলা যায় মধ্য প্রস্তর পর্বের সংস্কৃতির অগ্রগতি ভারতের সর্বত্র একই রীতি বা হারে হয় নাই।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .