প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে সাহিত্যের গুরুত্ব
জনশ্রুতি এবং লোককথা উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করা যায় না। ইতিহাসের তথ্য আরোহন করতে হয় বিশ্লেষণ পরীক্ষা, অনুধাবন এবং তথ্য প্রমাণ বিচার করে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শুধুমাত্র যুক্তি আর বাহ্যিক কিছু প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করা কখনই সম্ভব নয়। তার জন্য কিছু বিষয় তথ্য, উপাদানের উপর নির্ভর করতে হয়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা করা যথেষ্ট দুরহ ব্যাপার। কারণ ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী দর্শন ইহকালের অপেক্ষায় পরকালের গুরুত্বকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই প্রাচীন গ্রীসের মতো আমার দেশে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। প্রাচীনকালে যেসব গ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল, তাদের কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। (ক) সাহিত্য ভিত্তির লেখাগ্রন্থ, (খ) ধর্মভিত্তিক লেখা গ্রন্থ, (গ) স্মৃতিব্যাকরণ, বিষয়ক গ্রন্ত, (ঘ) জীবনকেন্দ্রিক রচিত গ্রন্থ, (ঙ) ইতিহাস ভিত্তিক রচিত গ্রন্থ।
আমাদের এই সকল গ্রন্থগুলির বেশিরভাগগুলি হল, সাহিত্য ভিত্তিক, তার থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে ইতিহাস কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারি, কিন্তু তার মধ্যে নানা বিতর্ক থেকে থাকে। ইতিহাস গ্রন্থের এই একান্ত অভাব বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মধ্যে অধিককাংশরই মত হল ভারতীয় লেখকরা ইহলৌকিক বিষয়ে ইতিহাস রচনায় উৎসাহিত হয় নি। প্রসঙ্গত স্মরণীয় এই বিষয়ে সুপন্ডিত আলবিরুনীর মতে হিন্দুরা বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক পরম্পরা বর্ণনায় তারা অত্যন্ত অনমনস্ক ছিলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ইতিহাসের পরিবর্তে কাহিনীকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এছাড়াও আরো একটি তথ্য উল্লেখ না করে থাকা যায় না, তা হল প্রাচীন ভারতে ‘হেরোডোটাস’, ‘লিভি’, ‘ট্যাকিটাস’ এর মত প্রতিভাবান ঐতিহাসিক জন্মগ্রহণ করেন নি। যাই হোক প্রাচীন ইতিহাস রচনার জন্য যে লিখিত মৌলিক ইতিহাস গ্রন্থের যথেষ্ট অভাব ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। যে সকল সাহিত্যগুলি আমরা পাই, তার মধ্য থেকে যে গ্রন্থগুলির মধ্যে ইতিহাসের সামান্যতম তথ্য পাওয়া যায়, সেই তথ্যগুলি তুলে ধরা হলঃ- বেদ, আনুমানিক ১৫০০ অব্দ খৃঃ ৯০০ অব্দের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যগুলি রচিত হয়েছিল। বেদগুলি থেকে বৈদিক আর্যদের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি এবং ধর্ম সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। বেদের প্রাচীনতম অংশের নাম ঋগ্ববেদ। এই বেদ থেকে ১০ রাজার যুদ্ধ, আর্য-অনার্য সংঘর্ষ এবং বহু রাজনৈতিক ঘটনার এবং “পুরুষসূত্রে” কথা জানতে পারা যায়।
যজুবেদ
এই বেদে শুধু মন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে যঞ্জেপুরোহিতের ব্যবহারের জন্য নানান বিধিনিয়ম।
সামবেদ
অসাধারণ সঙ্গীতের পরিপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থ থেকে ইতিহাসের খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।
অথর্ববেদ
অধিকাংশ স্থানেতেই আছে যাদুমন্ত্র, ভৌতিক আচরণ, সর্পবিদ্যা এবং আর্য-অনার্য সংমিশ্রণের অপূর্ব কাহিনী। যা সামাজিক ইতিহাস রচনার এক অপূর্ব নিদর্শন। এই বৈদিক গ্রন্থগুলি থেকে আমরা আর্য যুগের বিক্ষিপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারি।
মহাকাব্য
ঐতিহ্য অনুসারে রামায়ণ প্রাচীন এবং মহাভারত তার থেকে কিছুটা নবীন। রামায়ণ থেকে কৃষি ভিত্তিক সভ্যতার বহু তথ্য পাওয়া যায়। আর্য-অনার্য সংঘর্ষের তথ্য, প্রাচীন ভৌগোলিক তথ্য পাওয়া যায় এবং কি যুদ্ধাস্ত্রের ও চিকিৎসাবিদ্যার বহু তথ্য জানা যায়। মহাভারত থেকে রাষ্ট্রদর্শন, রাজনীতি, সামাজিক ইতিহাস, দর্শন তত্ত্ব এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনৈতিক চিত্র আমরা জানতে পারি।
জৈনসাহিত্য
ঐতিহ্য অনুসারে ২৪ জন তীর্থঙ্করকে নিয়ে জৈনধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। জৈনদের রচিত গ্রন্থগুলি থেকে আনুমানিক খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দির রাজনৈতিক চিত্রগুলি আমরা সংগ্রহ করতে পারি। এই গ্রন্থগুলিতে ষোড়শ মহাজনপথ, মগধের উত্থান, বিম্বিসার থেকে অজাতশত্রুর রাজকাহিনী আমরা জানতে পারি। ভদ্রবাহু রচিত জৈন কল্পসূত্র থেকে মহাবীরের জীবনী জানতে পারি। হেমচন্দ্রের লেখা ‘জৈন পরিশিষ্ট পার্বন’ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাহিনী মেরুতুঙ্গের সম্পাদিত ‘লোকপ্রবদ্ধচিন্তামনি’ এবং রাজশেখর সম্পাদিত ‘প্ৰবন্ধকোষ’ গ্রন্থ থেকে মগধের উত্থান ও মৌর্যদের রাজকাহিনী জানতে পারি। জৈন গ্রন্থগুলির মধ্যে জৈন ভগবতী সূত্র ইতিহাসের উপাদানের আকরগ্রন্থ।
পুরান সাহিত্য
পুরান বলতে বোঝায় পুরাকালের কাহিনী এবং ধর্মীয় অনুশাসনের সংক্ষিপ্তসার। পুরানের সংখ্যা আঠেরো, বেশির ভাগ পুরানই ধর্মকেন্দ্রিক। তার মধ্যে “মৎস্য, বায়ু, বিষ্ণু এবং ভগবত ও ভবিষ্যৎ পুরানেই ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়। এই পুরানগুলি থেকে সেযুগের রাজাদের বংশতালিকা, সময়কাল, যজ্ঞ, উপাধিলাভ, জনহিতকর কাজ আমরা জানতে পারি। প্রসঙ্গত স্মরণীয় প্রাচীন ভারতে ভৌগোলিক ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান হল পুরান।
বৌদ্ধ সাহিত্য
গৌতমবুদ্ধের ধর্মমত এবং জীবনকে কেন্দ্র করেই বৌদ্ধ সাহিত্যগুলি রচিত হয়েছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যগুলি থেকে আমরা ইতিহাসের অনেক তথ্য জানতে পারি এবং এই গ্রন্থগুলি পরোক্ষভাবে ইতিহাসকেন্দ্রিক। যেমন—দ্বীপবংশ এবং “মহাবংশ” থেকে সম্রাট অশোকের ইতিহাস জানতে পারি। মোটামুটি এই গ্রন্থগুলি ১০০০-১২৫০ খ্রীঃ এর মধ্যে লেখা হয়েছিল। বুদ্ধের জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল ‘জাতকগ্রন্থমালা’।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার বহু তথ্য পাওয়া যায়। প্রাচীনভারতের গিল্ড (শ্রেণী, গণ) ব্যবসা, বাণিজ্য, শ্রেষ্টি, বণিক, বাণিজ্যপোত, বাণিজ্যের বিভিন্ন উপকরণ, ব্যবসা নীতি, জাতিভেদ এবং প্রাচীন রাজপথ ও নগরের নাম ও বহু তথ্য আমরা জানতে পারি। বুদ্ধকে কেন্দ্র করেও বেশ কয়েকটি জীবনী গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। তার মধ্যে অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
সাহিত্য
মননের খাদ্য সাহিত্য এবং সাহিত্য রচিত হয় সমাজকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন ভারতে লেখা হয়েছিল অসংখ্য সাহিত্যগ্রন্থ, তার মধ্যে থেকে ইতিহাসের যে সামান্যতম তথ্য সংগৃহিত হয়, সেগুলির নামই উল্লেখ করা হল। অভিজ্ঞান শকুন্তলম্, মুদ্রারাক্ষস, দেবী চন্দ্রগুপ্তম্, মৃচ্ছকটিক, অদ্ভুদসাগর, দানসাগর, প্রতিষ্ঠা সাগর, আচার সাগর এবং বিভিন্ন ধর্মসূত্রগুলি থেকে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়। পানিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী, পতঞ্জলীর ‘মহাকাব্য’ থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের অনেক তথ্য জানতে পারি। মহাভাষ্য থেকে মৌর্য পরবর্তী শুঙ্গ রাজাদের কথা এবং ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের ভারত আক্রমণের কথা জানতে পারি। কালিদাসের রঘুবংশ নাটক থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল, ‘মালবিকামিত্রম্’ নাটক থেকে শুঙ্গ বংশের রাজকাহিনীর কিছু খন্ডিত চিত্র আমরা জানতে পারি। রাজা হর্ষবর্ধনের রচিত গ্রন্থ থেকেও সে সময়ের রাজনৈতিক তথ্য জানতে পারি।
জীবনী গ্রন্থ
প্রাচীনকালে বহু স্মরনীয় মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল, জীবনী গ্রন্থমালা। জীবনী প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে অশ্বঘোষ রচিত ‘বুদ্ধচরিতের’ নাম। হর্ষবর্ধনের জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’, কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ কলহন রচনা করেন ‘রাজতরঙ্গীনি’, ‘বিক্রমাদেবচরিত’, রচিত হয় চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যে জীবনকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও এই গ্রন্থ থেকে চালুক্যরাজ সোমেশ্বর ও দ্বিতীয় সোমেশ্বর এরও বহু তথ্য আমরা পাই। পালরাজা রামপালের জীবনকে কেন্দ্র করে রচনা করেছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’। এই গ্রন্থে কৈবর্ত বিদ্রোহের তথ্য আছে। জৈন লেখক জয়সিংহ চালুক্য রাজা কুমার পালের সম্বন্ধে একটি জীবনিগ্রন্থ রচনা করেন। পদ্যগুপ্ত রচনা করেন ‘নবশশাঙ্কচরিত’। এই গ্রন্থটি গুর্জরবংশীয় সিন্ধুদেশের রাজা নবশশাঙ্ককে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দিতে রচনা করেন বাপতির গৌড়রাজ হর্ষবর্ধনের বঙ্গবিজয়কে কল্পনা করে ‘গৌরবাহ’, নামে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
ঐতিহাসিক গ্রন্থ
প্রাচীন ভারতে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে যে প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল, তার নাম ‘রাজতরঙ্গীনি’ বা কাশ্মিরের ইতিবৃত্ত। এই গ্রন্থের লেখক “কলহন” প্রতিটি তথ্যকে তিনি বিচার বিশ্লেষণ করে অপক্ষপাত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রয়োজন মত লেখ, প্রশস্তি, সনদ, ভূমিদান পত্রের বিবরণ থেকে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেন, তার গ্রন্থে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করেছেন। তাই এই গ্রন্থটিকে আমরা প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থরূপে পরিচিত করতে পারি। কলহনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জোনরাজ, শ্রীবর প্রাজ্যভট্ট, শুক প্রভৃতি কবিরা কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। জোনরাজ লেখেন দ্বিতীয় রাজ তরঙ্গিনী। শ্রীবর রচনা করে জৈনরাজ তরঙ্গিনী। চালুক্য রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হল সোমেশ্বরের কীর্তি কৌমুদী, মেরুতুঙ্গের “প্রবক্ত চিন্তামণি”। রাজশেখরের “প্রবন্ধকোশ”, বালচন্দ্রের বসন্ত বিলাস বিশেষ করে স্মরণীয়। একই সময় নেপালের কয়েকখানি বংশাবলী লেখা হয়েছিল।
তামিল সাহিত্য
তামিল ভাষাও বহু প্রাচীন গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই ধরনের কয়েকখানি আদি গ্রন্থ নিয়েই “শঙ্গম সাহিত্য’। শঙ্গম সাহিত্য তামিল সাহিত্যের আদি রূপ। এই সাহিত্যের সময় কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দ এই দীর্ঘ সময় ধরে এই সাহিত্য রচনার পর্ব চলেছিল। এই যুগের স্মরণীয় কবি ছিলেন কপিকার। তার লেখা কুরিন চিপ্পাত্তু। কবি নক্কীরের রচিত গ্রন্থের নাম তিরুমরুকাক্র প্পদৈ।
বিজ্ঞান বিষয়ক
৪৯৯ খ্রীঃ রচিত আর্যভট্টের আর্যভট্টীয়, রবাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা ও বৃহৎ সংহিতা, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, শতানন্দের “ভাস্বতী” ভাস্করাচার্যের সিদ্ধান্ত শিরোমণি। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতীয় মনীষার অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যাবে এই সব বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত হয়েছিল চরকের (খ্রীষ্টীয় ১ম-২য় শতক) চরক সংহিতা, সুশ্রুতের সুশ্রুত সংহিতা, জনৈক অজ্ঞাত নামা লেখকের (৫ম-৬ষ্ঠ শতক) হস্তায়ুর্বেদ, বাগভটের (৮ম শতক) অষ্টাঙ্গ হৃদয় সংহিতা, চক্রপাণিদত্তের (১১দশ শতক) আয়ুর্বেদ দীপিকা, ভানুমতির চিকিৎসাসার সংগ্রহ ও. দ্রব্যগুণ সংগ্রহ সুরেশ্বরের (১১ দশ শতক) লৌহ পদ্ধতি ও বক্ষায়ুর্বেদ এবং বঙ্গসেনের চিকিৎসা সার সংগ্রহ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। কৃষি বিজ্ঞানের উপর পরাশর রচনা করে কৃষি পরাশর।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .