পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ
সংজ্ঞা
সৃষ্টির আদিমকালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনি রচনা ও প্রচার করে তাকে পৌরাণিক কাহিনি বা লােকপুরাণ (Myth) বলে। লােকপুরাণগুলি লােকসমাজের দ্বারা মৌখিকভাবে সুপ্রাচীন অতীত থেকে রচিত হয়ে আসছে। Myth শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Muthos’ থেকে।
বৈশিষ্ট্য-সাধারণ
চরিত্রগত
লােকপুরাণে কেন্দ্রীয় চরিত্র হল অলৌকিক দেবদেবীগণ। এতে কাহিনির মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর আরােপিত।
কাহিনিগত
পৌরাণিক কাহিনিগুলি মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য, দেবতা-মানবের জন্ম, মহা- প্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম- অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপপুণ্য সবই হল এর বিষয়।
শ্রেণিবিভাগগত
পৌরাণিক কাহিনি বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত যথা- [a] দৃষ্টিতত্ত্মূলক, [b] মানুষের উদ্ভবমূলক, [c] দৃষ্টিমূলক, [d] প্রলয়সূচক, [e] আগুনের অধিকার বিষয়ক, [f] সংস্কৃতির বিকাশ বিষয়ক, [৪] চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র কেন্দ্রিক, [h] সামাজিক বিধি বিধান বিষয়ক, [i] ধর্মাচার সম্পর্কিত, [j] সংস্কৃতি ধাতা (Culture Hero) বিষয়ক প্রভৃতি।
বিশ্বজনীনতাগত
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে বিশ্বসৃষ্টিগত ধারণা, মহাপ্লাবনগত বর্ণনা, দেবদেবীর সৃষ্টিগত ধারণা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বর্ণনার মিল লক্ষ করা যায়।
উৎসগত
বিশ্বের অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনিগুলির উৎসের সন্ধান মেলে মহাকাব্যগুলিতে এবং অন্যান্য উপাদানে। এমন বিশ্বের পাঁচটি প্রাচীনতম মহাকাব্য হল গিলগামেশ, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি।
ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনির পার্থক্যসমূহ
ইতিহাস
- অতীত দিনের কোনাে ঘটনার নিরপেক্ষ, সঠিক, তথ্যপূর্ণ, কালানুক্রমিক ধারাবাহিক বিবরণই হল ইতিহাস।
- মানুষ হল এর মূল চরিত্র। ইতিহাস মানবিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরােপিত। এর মূল চরিত্রটি মানুষের বাস্তবধর্মী সত্য ঘটনার রূপকার। অন্যান্য চরিত্রগুলি বাস্তবধর্মী হয়ে থাকে।
- এর বিষয় হল দেশ ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ মানবজীবন বা মানব সমাজের কাহিনি। ইতিহাসে বিষয় হিসেবে স্থান পায় মানব সমাজ, সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের কাহিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি।
- ইতিহাসের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কালপঞ্জি। এতে বর্তমান সময়ের নিরিখে অতীত ঘটনাবলির সালভিত্তিক ধারাবাহিক বর্ণনা থাকে।
- প্রকৃতিগত বিচারে এর কাহিনি বা ঘটনাবলি বাস্তবধর্মী। অতীত মানবসমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ সমস্টিগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, কর্মকাণ্ড প্রভৃতি একে ঐতিহাসিক চরিত্র দান করে।
পৌরাণিক কাহিনি
- সৃষ্টির আদিকালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনি রচনা ও প্রচার করে, তাকে পৌরাণিক কাহিনি বলে।
- অলৌকিক দেবদেবীরা এর মূল চরিত্র। এর মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলাকাহিনির রূপকার। অন্যান্য চরিত্রগুলিও অলৌকিক বা কাল্পনিক হয়ে থাকে।
- ধর্মভিত্তিক নানা বিষয় এতে স্থান পায়। বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, দেবতা-মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ নরক-পাপ-পুণ্য সমস্ত কিছুই হল এর বিষয়।
- এতে প্রক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনার সমাবেশ লক্ষ করা যায়। বর্তমান সময়ের নিরিখে এতে পৌরাণিক কল্পকাহিনির সালভিত্তিক ধারাবাহিক বর্ণনা থাকে না।
- প্রকৃতিগত বিচারে এগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক। এর কাহিনিগুলির মধ্যে অতীত দিনের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার রীতি নীতি, পূজা-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার প্রভৃতি একে পৌরাণিক চরিত্র দান করে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .