রাষ্ট্রকূটবংশের রাজনৈতিক ইতিহাস
চালুক্য বংশের ধ্বংস সাধন করে রাষ্ট্রকূটরা দক্ষিণ ভারতে প্রাধান্য স্থাপন করেন। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে রাষ্ট্রকূটদের মহাভারতের যদুবংশীয় সাত্যকির বংশধর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের আদি বাসভূমি ছিল মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক অঞ্চলে এবং এরা চালুক্যদের সামন্ত রাজা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এদের ভাষা ছিল “কানাড়ী”। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন “দস্তিদূর্গ”। কথিত আছে তিনি চালুক্য রাজ দ্বিতীয় কীতিবর্মনের নিকট হতে মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু অংশ অধিকার করেছিলেন। এছাড়াও কাঞ্চী কলিঙ্গ, মালব ও দক্ষিণ গুজরাটের রাজাদের পরাজিত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক Altekar মনে করেন যে দস্তিদূর্গের রাজ্যজয় অনেকটাই অতির রঞ্জিত। তবে তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য ও পুলকেশীর সঙ্গে যৌথভাবে আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এই প্রতিদানে চালুক্যরাজ তাকে ‘পৃথিবী বল্লভ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অন্যদিকে নিজেও ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। এরপর রাজা হন প্রথম কৃষ্ণ। তিনি ৭৫৮ – ৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তি বর্মনকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন যার ফলে চালুক্যশক্তি ৭৬০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই অবলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি মহীশূরের গঙ্গদের হারিয়ে দিয়ে তাঁদের রাজধানী মান্যপুর জয় করে নেন। পুত্র গোবিন্দকে পাঠান বেঙ্গীয় চালুক্যদের বিরুদ্ধে এবং সেখানেও রাষ্ট্রকূটরা জয়ী হয়, যার ফলে মহীশূরের অনেকটা অংশই তাদের অধিকারে আসে। তাঁর রাজত্বকালে ইলোরার কৈলাসনাথের মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় গোবিন্দ ও ধ্রুব
৭৭৩ খৃষ্টাব্দে প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ রাজা হন। তিনি বিলাসী ও অকর্মণ্য হওয়ায় শাসন ক্ষমতা চলে যায় তাঁর ছোট ভাই ধ্রুবের হাতে যিনি সুযোগ বুঝে ৭৮০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ সিংহাসন দখল করে নেন। দ্বিতীয় গোবিন্দ কাঞ্চী, গঙ্গবাড়ি, বেঙ্গী ও মালবের সামন্ত রাজাদের সাহায্যে সিংহাসন বজায় রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। ধ্রুব ক্ষমতা পেয়ে তাঁর দাদার সাহায্যকারী শক্তিগুলিকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গঙ্গরাজ শ্রীপুরুষ মুক্তরসকে পরাজিত করে তাঁর পুত্র শিববর্মাকে তিনি বন্দী করেন এবং গঙ্গবাড়িকে নিজ রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেন। তারপর তিনি পল্লবরাজ দত্তিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন, কিন্তু দস্তিবর্মা বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁর দেখাদেখি বেঙ্গীর শাসক চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধনও ধ্রুবের বশ্যতা স্বীকার করেন। অতঃপর ধ্রুব উত্তর ভারতে অভিযান করেন যেখানে কনৌজের অধিকার নিয়ে পালরাজ ধর্মপাল ও প্রতীহাররাজ বৎসরাজ যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৎসরাজ জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ধ্রুবের বাহিনী বৎসরাজকে বিজয়ের ফল ভোগ করতে দেয় নাই।
গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে ধ্রুব বৎসরাজকে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন যে বৎসরাজ রাজস্থানের মরুভূমিতে পলায়ন করতে বাধ্য হন। এরপর ধর্মপাল তাঁকে বাধা দিতে আসেন কিন্তু পরাজিত হয়ে তিনি শ্বেতচ্ছত্র ফেলে দিয়ে রণস্থল ত্যাগ করেন। ধর্মপাল অবশ্য বুদ্ধিমানের মত ধ্রুবের অধীনতা স্বীকার করে নিয়ে উত্তর ভারতে নিজ প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে নেন। কিছুকাল গঙ্গাতীরে বাস ও পূণ্যার্জন করে ধ্রুব লুণ্ঠিত ও উপঢৌকন-প্রাপ্ত প্রভুত সম্পদ নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। ৭৯৩ খৃষ্টাব্দের কিছু আগে ধ্রুবের মৃত্যু হয়।
তৃতীয় গোবিন্দ
ধ্রুব তাঁর তৃতীয় পুত্র গোবিন্দকে উপযুক্ত বিবেচনা করে পরবর্তী রাজা মনোনীত করেছিলেন, কিন্তু গোবিন্দের বড় ভাই স্তম্ভ বা কন্তু তা মেনে না নিয়ে কয়েকজন সাহায্যে বিদ্রোহ করেন। গোবিন্দ এই বিদ্রোহ দমন করেন, কিন্তু স্তম্ভের সঙ্গে তিনি উদার ব্যবহার করেন। তাঁকে তিনি গঙ্গরাজ্যে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তৃতীয় গোবিন্দ ৭৯৩ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেছিলেন। স্তম্ভের বিদ্রোহের কিছু আগে গোবিন্দ বন্দী গঙ্গ রাজকুমার শিববর্মাকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু শিবমার স্তম্ভকেই সাহায্য করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গোবিন্দ গঙ্গবাড়ি আক্রমণ করেন এবং শিবমারকে পুনরায় বন্দী করেন। এরপর তিনি পল্লবরাজ দন্তিদুর্গকে তাঁর অধীনতা মানতে বলপূর্বক বাধ্য করেন। এইভাবে ৭৯৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই গোবিন্দ সারা দক্ষিণাপথে একচ্ছত্র প্রাধান্য অর্জন করেন। অতঃপর তিনি উত্তরাপথ অভিযানে প্রবৃত্ত হন।
উত্তরাপথে তখন প্রতীহার বৎসরাজ পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজের সিংহাসন থেকে ধর্মপালের মনোনীত ব্যক্তি চক্রায়ুধকে উচ্ছেদ করে নিজেদের লোক ইন্দ্রায়ুধকে বসিয়েছেন, এবং ধর্মপালকে মুঙ্গেরের নিকটবর্তী স্থানে পরাজিত করেছেন। ভূপাল ও ঝাঁসির মধ্য দিয়ে গোবিন্দ তাঁর বাহিনী নিয়ে নাগভটের সম্মুখীন হন, এবং বুন্দেলখণ্ডের নিকটবর্তী স্থানে নাগভটকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন। পরাজিত নাগভট্ট রাজস্থানে পালিয়ে যান । ধর্মপাল এবং চক্রায়ুধ যুদ্ধ না করেই গোবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁর পুত্রের নন্জান-শাসনাবলী থেকে জানা যায় যে ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ বশ্যতা স্বীকার করার পর গাবিন্দ নর্মদার তীর ধরে ফিরে আসেন। পথে তিনি মালব জয় করেন এবং কোসল, কলিঙ্গ, বঙ্গ (বেঙ্গী?) ডাহল এং ওড্রক রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। গোবিন্দের উত্তরভারত অভিযানের কাল সম্ভবত ৮০০ খৃষ্টাব্দ।
বেঙ্গীর রাজা চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন, যিনি সম্পর্কে গোবিন্দের মাতুল ছিলেন, ৭১১ খৃষ্টাব্দে গিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য গোবিন্দের অধীনতা অস্বীকার করেন। গাবিন্দ তাঁকে পরাজিত করে তাঁর ভাই ভীম সলুকিকে বেঙ্গীর সিংহাসনে বসান। এটা ঘটেছিল ৮০২ খৃষ্টাব্দ নাগাদ। গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানকালীন অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে দক্ষিণের পল্লব, পান্ড্য, কেরল এবং গঙ্গরা একজোট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেছিল। এই অভ্যুত্থানকেও তিনি সফল ভাবে মোকাবিলা করেছিলেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .