প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের কৃতিত্ব
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে পল্লবদের উৎপত্তি একটি অমীমাংসিত বিষয়। পল্লবদের লেখ এবং স্থাপত্য নিদর্শনগুলি উত্তর পেন্নার এবং উত্তর বেল্লারের মধ্যবর্তী তোগুমন্ডলমে পাওয়া গেছে। কাঞ্চী ছিল পল্লবদের প্রধান প্রাণকেন্দ্র। প্রাচীন পল্লব রাজারা তাদের লেখগুলিতে প্রথমে প্রাকৃত এবং পরে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। তাদের প্রথম দিকের শাসন প্রণালীর সাথে সাতবাহন রাজত্বের শাসনপ্রণালীর সাথে মিল পাওয়া যায়। অনেক ঐতিহাসিক পল্লবদের তামিল বলে উল্লেখ করেছেন। কৃষ্ণস্বামি আয়াঙ্গারের মতে পল্লবগণ “তোল্ডাই মন্ডলমের’ বাসিন্দা ছিলেন। তিনি পল্লব এবং তোল্ডাইয়ার শব্দ দুইটি সমার্থক মনে করেন। অন্যদিকে লেখক রসনায়কমের মতে পল্লবগণ ছিলেন দক্ষিণ ভারত অথবা সিংহলের তামিল, এবং তাদের সাথে চোল অথবা চোল নাগগণের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। শ্রীনিবাস আয়াঙ্গারের মতে পল্লবগণ ছিলেন প্রাচীন নাগবংশীয়। ইতিহাসবিদ ডি. সি. সরকার মনে করেন যে সাতবাহন রাজত্বের শেষ দিকে পল্লবগণ হয়ত তাদের অধীন প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। পল্লবদের উত্থান খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে হয়েছিল। তার প্রধান প্রমাণ হল এই শতাব্দীতে পল্লববংশীয় কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপের সঙ্গে গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের যুদ্ধ হয়েছিল এবং বিষ্ণুগোপ তাঁর অধিনতা স্বীকার করেছিলেন।
প্রথম পর্বের পল্লব রাজাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিবস্কন্দবর্মন। তিনি খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজত্ব করেন এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। বিষ্ণুগোপের রাজত্বকাল আনুমানিক ৩৫০-৩৭০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ছিল। অন্যতম পল্লব রাজ বীর কুর্চ নাগদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী রাজা হলেন স্কন্দশিষ্য। তিনি কাঞ্চীর ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। এর পর রাজা হন সিংহবর্মন এবং ৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ দ্বিতীয় সিংহবর্মনের রাজত্বের অবসান ঘটেছিল।
দ্বিতীয় সিংহ বর্মনের পুত্র ছিলেন সিংহবিষ্ণু। তাঁর রাজত্ব কাল থেকেই পল্লবদের ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। আনুমানিক ৬১০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন।
দ্বিতীয় সিংহবর্মনের পট্টে (লেখমালা) তাঁকে সত্য, ত্যাগ, বিনয় এবং ক্ষত্রগুণের আধার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি কাবেরী নদীর ব-দ্বীপে চোল অঞ্চল জয় করেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি শিবের উপাসনায় ব্রতী হন। তাঁর সময় বাতাপির চালুক্য শক্তির উত্থান ঘটেছিল।
সুপ্রসিদ্ধ লেখক দন্ডিপ তাঁর রচিত “অবন্তি সুন্দরি কথাসারে” সিংহবিষ্ণুর রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন “ভারবি” বলে উল্লেখ করেছেন। সিংহবিষ্ণু বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন এবং “অবনি সিংহ” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। মহাবলিপুরমের “বরাহ গুহা”র স্থাপত্য কীতির পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের কৃতিত্ব
সিংহ বিষ্ণুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম “মহেন্দ্রবর্মন” রাজা হন। তিনি ৬৩০ খ্রীঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশির সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর সময় পল্লব রাজ্য উত্তরে কৃষ্ণা নদী থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর সময় দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের মধ্য দিয়ে এবং নায়নার এবং আলবারগণের প্রচারের ফলে, এই যুগে, তামিল অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের ও শিল্পের নব জাগরণ ঘটেছিল।
মহেন্দ্ৰবর্মনই প্রথম তোল্ডাই মন্ডলমে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণের প্রথার সূচনা করেন। তিনিই প্রথম তার লেখগুলি প্রস্তর গাত্রে খোদাই করা শুরু করেন। তিনি নিজে একাধারে কবি ও নাট্যকার ছিলেন। ভারবি ও দন্ডিণের মত পন্ডিত ব্যক্তিরা তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালেই সূচনা হয় দীর্ঘস্থায়ী “পল্লব চালুক্য যুদ্ধ”। মহীশূরের “গঙ্গাগণ” এই যুদ্ধে বাতাপির চালুক্যদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশি পল্লবদের উচ্চাশা প্রতিহত করতে এবং বেঙ্গির উপর পল্লবদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। এছাড়াও পল্লবদের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগের একচেটিয়া অধিকার ক্ষুণ্ন করাও চালুক্যদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল। তৃতীয় কারণ ছিল পল্লবদের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগের একচেটিয়া অধিকার ক্ষুণ্ন করা ও চালুক্যদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল। তৃতীয় কারণ ছিল পল্লবদের সঙ্গে কদম্বদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যা বাতাপির চালুক্যদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করেছিল। এই সব কারণে দীর্ঘস্থায়ী “পল্লব চালুক্য” যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। তাই পল্লব রাজ্যের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশী আক্রমনাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই যুদ্ধে মহেন্দ্রবর্মন রাজধানী রক্ষা করতে পারলেও তাঁর রাজ্যের উত্তরভাগ হারাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
প্রথম মহেন্দ্ৰবৰ্মন অনেক উপাধি গ্রহণ করেন। যেমন সত্যসন্ধ, মত্তবিলাস পুরুষোত্তম বিচিত্রচিত্র, অনিত্যরাগ ইত্যাদি। শুধু যুদ্ধ নয শান্তিপূর্ণ কাজেও তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮ খ্রীঃ) রাজা হন। তিনি ছিলেন পল্লব রাজাদের মধে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি একাধিকবার দ্বিতীয় পুলকেশীকে পরাজিত করেছিলেন এবং চালুক্য রাজধানী বাতাপি পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। সিংহলের সিংহাসনে নিজ অনুগত মানবমণকে প্রতিষ্ঠা করেন। মামল্লপুরমের শিল্প নিদর্শন গুলির স্রষ্টাও তিনিই ছিলেন। তিনি “বাতাপি কোল্ড” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .