দেবপালের কৃতিত্ব
শশাংকের মৃত্যুর পর প্রায় শতবর্ষ সমগ্র বাংলাদেশেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির রাজত্ব চলেছিল। তার ফলে পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহের লেগেই থাকত। এই অস্থির অবস্থায় ৭৫০ খ্রীঃ গোপাল পালবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা গোপালের পুত্রের নাম ধর্মপাল। ধর্মপাল ৭৭০ খ্রীঃ রাজা হলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই বৃহত্তর ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন সুনিপুন যোদ্ধা ও রাজনীতিজ্ঞ। তিনি ক্ষুদ্র পালরাজ্যকে সাম্রাজ্যের মর্যাদায় উন্নত করিতে সমর্থ হন। সমগ্র আর্যাবতে এক সার্বভৌম রাজশক্তি স্থাপন করাই ছিল তার জীবনের স্বপ্ন।
সাম্রাজ্য বিস্তার
হর্ষবর্ধনের সময় থেকে কনৌজের প্রতিপত্তি বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কনৌজকে অধিকারে রাখা যে কোন রাজশক্তির কাছে একটা গৌরবের ব্যাপার বলে পরিগণিত হয়। সেই সময় উত্তর ভারতের প্রভুত্ব নিয়ে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। ধর্মপাল ও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগদান করেন। তাঁর সময় প্রতিহার যথাক্রমে বৎসরাজ ও দ্বিতীয় নাগভট্ট এবং রাষ্ট্রকূট রাজা ছিলেন ধ্রুব ও তৃতীয় গোবিন্দ। ‘কনৌজ’ অধিকার নিয়ে এই তিন শক্তির যে সংগ্রাম শুরু হয় তা ত্রি-শক্তি সংগ্রাম নামে ইতিহাসে পরিচিত। এই সময় ধর্মপাল সাম্রাজ্য বিস্তার কল্পে পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হলে প্রতিহার রাজ বৎসরাজ তাকে পরাজিত করেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় বৎসরাজ রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের নিকট পরাজিত হয়ে রাজস্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই সুযোগে ধর্মপাল পুনরায় উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারে অগ্রসর হলেন। এদিকে ধ্রুব বৎসরাজকে পরাজিত করেই ক্ষাপ্ত রহিলেন না। তিনিও ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। ধর্মপাল ইতিমধ্যে মগধ, বারাণসী, প্রয়াগ জয় করে আরো পশ্চিমে অগ্রসর হলে রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত ও বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর ধ্রুব দক্ষিণাপথে ফিরে যান। এই অবস্থায় ধর্মপাল পুনরায় রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। এরপর তিনি কনৌজের রাজা ইন্দ্রাযুধকে পরাজিত করে নিজ মনোনীত চক্ৰায়ুধকে কনৌজে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। খালিমপুর তাম্রশাসনে উল্লেখিত আছে কনৌজের সিংহাসনে চক্রায়ুধের অভিষেকের সময় ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, অবন্তী গান্ধার প্রভৃতি রাজ্যের নৃপতিরা উপস্থিত ছিলেন। এর থেকে মনে হয় ধর্মপালের প্রাধান্য উক্ত রাজন্যবর্গ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল। তাম্রশাসনে আরো উল্লেখিত আছে কনৌজের উপর আধিপত্য বজায় রেখে তিনি সিন্ধুনদ ও পাঞ্জাব পর্যন্ত অগ্রসর হন। এমনকি বিন্ধ্যপর্বত ও অতিক্রম করেছিলেন। “স্বয়ম্ভুপুরানে” বলা হয়েছে যে নেপালও ধর্মপালের আনুগত্য স্বীকার করেছিল।
কিন্তু ধর্মপালকে পুনরায় পুরাতন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। প্রতীহার রাজ বৎসরাজের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ আক্রমণ করে চক্রায়ূধকে বিতাড়িত করে নিজের লোক ইন্দ্রায়ুধকে পুনরায় কনৌজের রাজা করেন। এই ঘটনায় বিরুদ্ধে ধর্মপাল প্রতিকার করতে গিয়ে মুঙ্গের নিকটবর্তী স্থানে নাগভট্টের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হলেন। রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ নাটকীয়ভাবে এক্ষেত্রেও আবির্ভূত হলেন এবং নাগভট্টকে পরাজিত করলেন। বুদ্ধিমান ধর্মপাল আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃতীয় গোবিন্দের অধীনতা স্বীকার করে নিলেন এবং অল্পদিন পরে গোবিন্দ দক্ষিণ ভারতে ফিরে গেলে প্রথমবারের মত এবারেও পরাভব মেনেও ধর্মপাল সকল বিষয়ে লাভবান হলেন। এর পর তিনি উত্তর ভারতে নিজ প্রভুত্ব পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
গুরুত্ব
বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মপালের রাজত্বকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজ বাহুবলে বাংলায় শুধু যে শান্তি স্থাপন করেছিলেন তাই নহে, বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। উত্তর ভারতে পাল রাজত্বের বিস্তার করে বাংলার সন্মান বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি “পরমেশ্বর”, “পরমভট্টারক” ও “মহারাজাধিরাজ” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ছিলেন এবং বিক্রমশিলা ও সোমপুরী মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ দার্শনিক হরিভদ্রের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি শাস্ত্রানুশাসন অনুসারে রাজ্য শাসন করতেন। পরিশেষে বলা যায় ‘ধর্মপালের রাজত্বকাল “বাঙালীর জীবন প্রভাত”।
দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রীঃ)
ধর্মপালের পুত্র দেবপাল যে শুধু পিতৃ পুরুষের অর্জিত রাজ্য বজায় রেখেছিলেন তাই নয় সেই রাজ্যের আয়তনও বৃদ্ধি করেছিল। তাঁর আমলের লেখমালাসমূহ তাঁকে হিমালয় থেকে বিন্ধ্য ও পশ্চিম থেকে পূর্ব সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার লেখমালা সমূহ থেকে এও জানা যায় যে তিনি পশ্চিমে কম্বোজ এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য অঞ্চল অধিকার করে উৎকলদের উৎঘাত করেছিলেন। এরপর প্রাগজ্যোতিষ জয় করেছিলেন এবং হূণদের দর্পচূণ করেছিলেন। এছাড়াও দ্রাবিড় ও গুর্জররাজাদের গৌরব খর্ব করেছিলেন। বিশেষভাবে স্মরণীয় দেবপালের এই বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের পেছনে মন্ত্রী দর্ভপাণি ও কেদারমিশ্রর অবদান নেহাত কম নয়।
রাজ্যজয়
দেবপাল বাংলার রাজা হয়ে প্রথমে উড়িষ্যা ও আসামের দিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং দুইটি রাজ্যই তিনি তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন। গুরব মিশ্রের লিপি অনুসারে হূণজাতির গর্ব খর্ব করে কম্বোজ জয় করেন। এরপর প্রতিহার রাজ ভোজকে পরাজিত করেন সম্ভবত ৮৪০ হতে ৮৬০ খ্রীঃ মধ্যে এই যুদ্ধটি হয়েছিল। মুঙ্গেরে প্রাপ্ত দেবপালের তাম্রশাসনে তার সাম্রাজ্য হিমালয় হতে রামেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে বর্ণনা আছে। কিন্তু ইহা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। দেবপাল যে দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট রাজাকে পরাজিত করেছিলেন তা ঐতিহাসিক স্বীকৃত আবার বিতর্কিত, কারণ ধর্মপালের আমলে রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে একটা কূটনৈতিক বোঝাপড়া ছিল। সেই সময় রাষ্ট্রকূট রাজা ছিলেন অমোঘবর্ষ। তিনি শান্তিবাদী হলেও দুর্বল ছিলেন না এবং স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রকূট শক্তিকে ঘাঁটিয়ে পালদের কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত না। রাজনৈতিক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন রাজা দেবপাল এইরূপ কাজ করেন নাই বলেই মনে হয়।
গুরুত্ব
দেবপালের আমলে পাল সাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে উঠেছিল। তাঁর আমলে বাঙ্গালী সেনা ব্রহ্মপুত্র হতে সিন্ধুনদ এবং দক্ষিণ ভারতে বিজয়াভিযানে অগ্রসর হয়েছিল। ভারতের বাহিরের দেবপালের খ্যাতি বিস্তার লাভ করেছিল। সুমাত্রার শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজ বালপুত্রদেব তার নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং নালন্দা বিহারে একটি মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। আরব পর্যটক সুলেমানের বিবরণ থেকে জানা যায় দেবপালের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকূট এবং প্রতিহারগণ অপেক্ষা অধিক সুদক্ষ ও শক্তিশালী ছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে আর্যাবতে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এইরূপ শক্তি ও সমৃদ্ধির পরিচয় এর পূর্বে বা পরে আর কখনও পাওয়া যায় নাই।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .