দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট শক্তির উত্থান বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন প্রথম ইন্দ্রের পুত্র দস্তিদূর্গ। আনুমানিক ৭৪৩ খ্রীঃ দস্তিদূর্গ সিংহাসনে বসেন। তিনি চালুক্যদের পরাজিত করেন। আরবদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। পল্লব ও নন্দিপুরী গুর্জরদের পরাজিত করে মহারাষ্ট্র ও গুজরাত অঞ্চল অধিকারে নিয়ে আসেন।
৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দের কিছু আসে দস্তিদূর্গের মৃত্যু ঘটলে তার কাকা প্রথম কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন। দস্তিদূর্গ কর্তৃক পরাজিত চালুক্য রাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মা কর্ণাটক অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু প্রথম কৃষ্ণ তাঁকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন। যার ফলে চালুক্য শক্তি ৭৬০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই অবলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপুর তিনি মহীশূরের অঙ্গদেব কে হারিয়ে দিয়ে তাদের রাজধানী মান্যপুর জয় করে নেন।
দ্বিতীয় গোবিন্দ ও ধ্রুব
৭৭৩ খ্রীঃ প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যু হলে তার পুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ রাজা হন। তিনি বিলাসী ও অকমর্থ্য হওয়ায় শাসন ক্ষমতা চলে যায় তার ছোট ভাই ধ্রুবের কাছে। এই সুযোগে ৭৮০ খ্রীঃ নাগাদ সিংহাসনে বসেন। দ্বিতীয় গোবিন্দ কাঞ্চী, গঙ্গবাড়ী, বেঙ্গী ও মালরে সামন্ত রাজাদের সাহায্যে প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। ধ্রুব ক্ষমতা পেয়ে দাদার সাহায্যকারী শক্তিগুলিকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গঙ্গরাজ শ্রীপুরু মুন্ডবণকে পরাজিত করে তার পুত্র শিবমারকে বন্দী করেন এবং গঙ্গ বাড়ীকে নিজ রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেন। তারপর তিনি পল্লবরাজ দন্তি বর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু দন্তিবর্মা বশ্যতা স্বীকার করেন। তার দেখাদেখি বেঙ্গীর শাসক চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন ও ধ্রুবে বশ্যতা স্বীকার করেন।
অতঃপর ধ্রুব উত্তর ভারতে অভিযান করেন যেখানে কনৌজ অধিকার নিয়ে পালরাজ ধর্মপাল ও প্রতিহার রাজ বৎসরাজ যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৎসরাজ জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ধ্রুবের বাহিনী বৎসরাজকে বিজয়ের ফলভোগ করতে দেয়নি। গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে ধ্রুব বৎসরাজকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন তার ফলে বৎসরাজ রাজস্থানের মরুভূমিতে পলায়ন করতে বাধ্য হন। এরপর ধর্মপাল তাঁকে বাধা দিতে আসেন কিন্তু পরাজিত হয়ে তিনি শ্বেতচ্ছত্র ফেলে দিয়ে রণস্থল ত্যাগ করেন। ধর্মপাল অবশ্য বুদ্ধি মানের মত ধ্রুবে অধীনতা স্বীকার করে নিয়ে উত্তর ভারতে নিজ প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে নেন। কিছুকাল গঙ্গার তীরে বাস ও পূর্ণাজন করে ধ্রুব লুণ্ঠিত ও উপঢৌকন প্রাপ্ত প্রভৃত সম্পদ নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। ৭৯৩ খ্রীঃ কিছু আগে রাজা ধ্রুবের মৃত্যু হয়।
তৃতীয় গোবিন্দ
ধ্রুব তার পুত্র তৃতীয় গোবিন্দকে উপযুক্ত বিবেচনা করে পরবর্তী রাজা মনোনীত করেছিলেন, কিন্তু গোবিন্দ বড় ভাই স্তম্ভ বা কন্তু তা মেনে না নিয়ে কয়েকজন সামন্ত সাহায্যে বিদ্রোহ করেন। গোবিন্দ এই বিদ্রোহ দমন করেন। তৃতীয় গোবিন্দ ৭৯৩ খ্রীঃ সিংহাসন বসেছিলেন।
৭৯৫ খ্ৰীঃ মধ্যে গোবিন্দ সারা দক্ষিণাপথে একছত্র প্রাধান্য অর্জন করেন। অতঃপর তিনি উত্তরাপথ অভিযানে অগ্রসর হন। এই সময়ে উত্তরাপথে প্রতীহার বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজের সিংহাসন থেকে ধর্মপালের মনোনীত ব্যক্তি চক্ৰায়ুধকে উচ্ছেদ করে নিজেদের লোক ইন্দ্ৰয়ুধ বসিয়েছিলেন এবং ধর্মপালকে মুঙ্গেরের নিকটবর্তী স্থানে পরাজিত করেন ইতিমধ্যে। ভূপাল ও ঝাঁসির মধ্যে দিয়ে গোবিন্দ তার বাহিনী নাগভট্টের সম্মুখীন হন এবং বুন্দেলখন্ডের নিকটবর্তী স্থলে নাগভট্টকে শোষনীয় ভাবে পরাজিত করেন। পরাজিত নাগভট্ট রাজস্থানে পালিয়ে যান এরপর ধর্মপাল এবং চক্রায়ুধ যুদ্ধ না করেই গোবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তার পুত্রের সনজন শাসনাবলী’ থেকে জানা যায় যে ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ বশ্যতা স্বীকার করার পর গোবিন্দ নর্মদা তীর ধরে স্বদেশে ফিরে যান। পথে তিনি মালবজয় করেন এবং কোশল কলিঙ্গ, বঙ্গ ডাহল এবং ওড্রক রাজারা তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। গোবিন্দ উত্তর ভারত অভিযান কাল সম্ভবত ৮০০ খ্রীঃ নাগাদ।
গোবিন্দ উত্তর ভারত অভিযানকালীন অনুপস্থিত সুযোগে নিয়ে দক্ষিণে পল্লব, পান্ড্য, কেরল এবং গঙ্গরা একজোট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। কিন্তু গোবিন্দ ৮০২ খ্রীষ্টাব্দে নাগাদ তাদের সহজে পরাস্ত করেছিলেন এবং কাঞ্চী দখল করেছিলেন।
অমোঘবর্ষ
তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর তার পুত্র অমোঘবর্ষ ৮১৪ খ্রীঃ নাবালক অবস্থায় সিংহাসন আরোহণ করেন। তার অভিভাবক ছিলেন গুজরাট রাষ্ট্রকূট শাসক কক্ক, যিনি সম্পর্কে তার পিতৃব্য ছিলেন। অমোঘবর্ষের নাবালকত্বের সুযোগে রাষ্ট্রকূট সামন্তদের বিদ্রোহ হয়েছিল। গঙ্গদের সঙ্গে ও অমোসবর্ষের দীর্ঘকাল যুদ্ধ চলে এবং পরিশেষে অমোঘবর্ষের কন্যার সঙ্গে ভূতগ নামক জনৈক গঙ্গ রাজপুত্রের বিবাহ মারফৎ উভয় তরফে মধ্যে সন্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়। অমোঘবর্ষ মাম্যখেট নামক স্থানে নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
দ্বিতীয় কৃষ্ণ
৮৭৮ খ্রীঃ অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর তার পুত্র ি দ্বিতীয় কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন। কৃষ্ণের সঙ্গে প্রতিহার ও পূর্বী – চালুক্যদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছিল। প্রতিহার রাজ ভোজ ছিলেন এক্ষেত্রে তাঁর প্রতিপক্ষ। রাষ্ট্রকূটদের লাট বা গুজরাত শাখার লেখমালা সমূহ থেকে জানা যায় যে প্রতিহারদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণের সামিল হয়েছিল। দ্বিতীয় কৃষ্ণ চোল রাজা প্রথম অদিত্যের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন।
তৃতীয় ইন্দ্র
৩৬ বছর রাজত্বে করার পর ৯১৪ খ্রীঃ দ্বিতীয় কৃষ্ণ মারা যায় গেলে তার পৌত্র তৃতীয় ইন্দ্র রাজা হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগতুঙ্গ তাঁরা জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিলেন। তৃতীয় ইন্দ্র সামরিক প্রতিভের অধিকারী ছিলেন, এবং সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি প্রতিহার রাজ মহীপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করেন। ভূপাল, ঝাঁসির মধ্যে দিয়ে তাঁর বাহিনী যমুনা অতিক্রম করে এবং কনৌজ দখল করে। ৯১২ খ্রীঃ তৃতীয় ইন্দ্র মারা গেলে তার পুত্র দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ সিংহাসনে বসেন, কিন্তু তাঁর ভাই চতুর্থ গোবিন্দের চক্রান্তে প্রাণ হারান।
তৃতীয় অমোঘবর্ষ
শাসক হিসাবে চতুর্থ গোবিন্দ অত্যাচারী ছিলেন ফলে তার মন্ত্রীরা এবং সামন্তবগ তার মুল্লতাত তৃতীয় অমোঘবর্ষকে রাষ্ট্রকুট সিংহাসন দখল করতে উৎসাহিত করেন এবং খুব সহজেই অমোঘবর্ষ গোবিন্দকে পরাজিত করে ৯৩৬ খ্রীঃ সিংহাসন দখল করেন।
তৃতীয় কৃষ্ণ
৯৩৯ খ্রীঃ তৃতীয় অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর তৃতীয় কৃষ্ণ সিংহাসন আরোহণ করেই চোল রাজ্য আক্রমণ করেন, তৃতীয় কৃষ্ণই শেষ পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকূট যিনি ধ্রুব, তৃতীয় গোবিন্দ ও তৃতীয় ইন্দ্রের সাথক উত্তরাধিকারী ছিলেন। রাজা এরপরই রাষ্ট্রকূট বংশের অবসান ঘটে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .