কৈবর্ত্য বিদ্রোহের গুরুত্ব
রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালের ১ম পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০-১০৭১ খ্রীঃ) সিংহাসনে বসেন। দ্বিতীয় মহীপালের সিংহাসন লাভ নিরুপদ্রব ছিল না। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল। তাঁর সন্দেহ হয়েছিল এই বিদ্রোহে তার ভ্রাতা রামপাল সক্রিয় আছেন। সেই কারণে রামপালকে কারাগারে বন্দী করলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। অল্পদিনের মধ্যেই সামন্তদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। এই বিদ্রোহে তিনি পরাজিত ও নিহত হলেন। এর ফলে কৈবর্ত জাতির এক উচ্চপদস্থ কর্মচারি ‘দিব্য’ বরেন্দ্রের সিংহাসন অধিকার করেন।
উপাদান ও তথ্য
এই বিদ্রোহের বিবরণ সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি রামপালের সমর্থক ছিলেন। এছাড়াও কুমার পালের মন্ত্রী বৈদ্যৎদবের কামাউলি পট্টে খ) মদনপালের মানাহালি দান পত্রে গ) পূর্ববঙ্গের বর্মন বংশীয় ভোজবর্মনের বেলবা দানপত্রে এই ঘটনার উল্লেখ আছে।
কৈবর্ত কারা? রাজশাহীর কাছে ভাতুরিয়ায় রাজ্যপালের মন্ত্রী যশোদাস একটি লিপিতে চাষা কৈবর্ত শ্রেণীর উল্লেখ আছে। এরা রাজ্যপালকে সাহায্য করেছিলেন এবং মন্ত্রী যশোদাস এই কৈবর্ত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন তথ্য অনুসারে ‘দিব্য’ এই যশোদাসের পরিবারের মানুষ ছিলেন। এরা পরবর্তীকালে দাস এবং কুন্ডু পদবী ব্যবহার করত এবং পাল যুগের এদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
দিব্য
রামচরিতে কৈবত বিদ্রোহ ও তা দমনের জন্য রামপালের যুদ্ধাভিযান বর্ণিত আছে। রামচরিতে দিব্যকে ‘দস্যু’ ও উপাধিব্রতী বলা হয়েছে। উপাধিব্রতীর অর্থ হল ছদ্মনিব্রতী। এ হতে অনেকে মনে করেন যে দিব্য কর্তব্য পালনের জন্য বিদ্রোহীর ছদ্মবেশে মহীপালকে হত্যা করেছিলেন। ডঃ আর সি মজুমদার এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তার মতে ‘রামচরিত’ কারের মতে দিব্য প্রকৃতই দস্যু ছিলেন এবং দেশহিতের ভান করে মহীপালকে হত্যা করেন। কারো মতে দিব্য কুশাসক ও অত্যাচারী মহীপালকে হত্যা করে দেশ রক্ষা করেছিলেন। এবং তাঁর জন্য বরেন্দ্রের জনগণ তাকে রাজপদে নির্বাচিত করেছিলেন। তারা দিব্যকে মহাপুরুষ সাজিয়ে উত্তরবঙ্গে ‘দিব্যস্মৃতি’ উৎসব পালন করতেন। কিন্তু রামচরিতে এর সমর্থন পাওয়া যায় না।
দিব্যর রাজনৈতিক ঘটনা
দিব্য নিশ্চিন্তে রাজ্য ভোগ করতে পারেন নাই। কিছুদিন তিনি পূর্ববঙ্গের বর্মনবংশীয় রাজা জাতবর্মা ও রামপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বুঝা যায় তিনি বেশ শক্তিশালী ছিলেন এবং বরেন্দ্রভূমিতে তার প্রভুত্ব সুদৃঢ় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতবর্মা দিব্যকে পরাস্ত করেন। দিব্যের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা রুদ্রোেক ও তার পরে ভীম বরেন্দ্রভূমিতে রাজত্ব করেন। রামচরিতে ভীম সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশংসাসূচক শ্লোক আছে। দিনাজপুরের কৈবর্ত স্তম্ভ আজও কৈবর্তবংশের স্মৃতি বহন করে।
কৈবত্যরাজ ভীম ও রামপালের যুদ্ধ
রামচরিত গ্রন্থে এই যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। সম্ভবত রামপাল বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করবার পূর্বেই দিব্য মারা যান। দিব্যের মৃত্যুর পর ভীম রাজা হন। তার সাথে রামপালের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। অবশেষে ভীম বন্দী হলে তার সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরিবার সহ ভীমকে হত্যা করা হয়। এইভাবে কৈবত্য রাজবংশের অবসান ঘটে।
সামাজিক তাৎপর্য
এই বিদ্রোহের সামাজিক তাৎপর্য খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না। তৎকালিন সমাজে সামন্ততন্ত্র কতটা দৃঢ়মূল হয়েছিল এবং রাষ্ট্রের পক্ষে কতটা বিপদজনক হয়ে উঠেছিল তা এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ করা যায়। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে রাজশক্তির এই সংঘর্ষে সামন্ততন্ত্র সাময়িকভাবে জয়ী হলেও চিরজয়ী হয়নি – এই ঐতিহাসিক সত্যও উপেক্ষা করা যায় না। আবার নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে যে গভীর আত্মপ্রত্যয় এর সঞ্চার করেছিল তাও অস্বীকার করা যায় না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .