প্রথম আফিম যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
এই অবস্থায় আফিমের ব্যবসা বন্ধকরার জন্য মাঞ্জু সরকার ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেশি কিছু কঠোর নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করে। এতে কোন কাজ না হলে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে লিন্ জে সু নামে জনৈক দেশপ্রেমিক কর্মচারীকে ক্যান্টন বন্দরের কমিশনার নিযুক্ত করে তার ওপর আফিমের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে ২০ হাজার পেটি আফিম বাজেয়াপ্ত করে সর্বসমক্ষে তা ধ্বংস করেন (৩রা জুন, ১৮৩৯ খ্রিঃ)। তিনি ঘোষণা করেন যে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আফিমের ব্যবসা করলে অপরাধীদের মৃতুদণ্ড দেওয়া হবে এবং সরকারের বিনা অনুমতিতে কোন ব্রিটিশ জাহাজ চীনের বন্দরে ভিড়তে পারবে না। ক্ষুদ্ধ ব্রিটিশ সরকার এই ঘটনাকে উপলক্ষে করে চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করলে চীন তা অগ্রাহ্য করে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের জন মাসে ব্রিটিশ সেনা চিন আক্রমণ করলে ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা প্রথম অহিফেনের যুদ্ধ শুরু হয়।
এই যুদ্ধের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। চীন সরকার এই যুদ্ধকে চিনের ওপর জোর করে আফিম চাপবার যুদ্ধ বলে মনে করত। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক ইমান্যুয়েল সু বলেন যে, চিনাদের কাছে এই যুদ্ধ ছিল মূলত আফিমের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা। এই কারণে তাঁরা এই যুদ্ধের নামকরণ করেন অহিফেন যুদ্ধ । অপরদিকে হ্যারল্ড ভিনাক এর মতে, আফিম কখনই যুদ্ধের কারণ ছিল না, ছিল উপলক্ষ মাত্র। তাঁর মতে অপমানজনক ক্যান্টনপ্রথা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতির মধ্যে যুদ্ধের কারণ নিহিত ছিল। উইলোবি ও রজার্স এর মতে, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে বোস্টন বন্দরে চায়ের পেটি সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ যেমন যুদ্ধের কারণ ছিল না, তেমনি কমিশনার ল্ িকর্তৃক আফিমের পেটির ধ্বংস সাধনও যুদ্ধের কারণ ছিল না। আসলে ইংরেজরা চেয়েছিল সমানাধিকারের ভিত্তিতে বাণিজ্য করার অধিকার এবং ক্যান্টনপ্রথার অবসান। ওয়েন ল্যাটিমোর বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ ছিল চিনে ব্রিটিশদের অবাধ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা এবং চিনের বাণিজ্যবন্দর অধিকারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। বস্তুত, আফিমই যদি যুদ্ধের প্রকৃত কারণ হত, তাহলে নানকিং সন্ধিতে নিশ্চয়ই এ সম্পর্কে উল্লেখ থাকত। ঐ সন্ধি আফিম সংক্রন্ত কোন শর্তে অনুল্লেখই প্রমাণ করে যে, এই যুদ্ধের প্রকৃত কারণ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ।
নানকিং সন্ধি
প্রথম অহিফেন যুদ্ধ দুবছর (১৮৪০-৪২ খ্রিঃ) চলে এবং দুর্বল চিনা সেনাদল পরাজিত হয়ে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে আগস্ট ইংরেজদের সঙ্গে নানকিং এর সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে (১) ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও এবং নিংপো – এই পাঁচটি বন্দর ইউরোপীয়দের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই বন্দরগুলিতে ইউরোপীয়রা নিজ নিজ কন্সাল নিয়োগের অধিকার পায়। (২) হংকং বন্দর ইংরেজদের চিরকালের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। (৩) ‘কো-হং’ প্রথা অবলুপ্ত হয় এবং চিনের সর্বত্র ইংরেজ বণিকদের মাল ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার স্বীকৃত হয় (৪) চিনে ব্রিটিশ আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫% শুল্ক ধার্য করা হয়। (৫) ক্যান্টনে আফিম ধ্বংস করার জন্য মাঞ্জু সরকার ইংরেজদের ৬ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার এবং ‘কো-হং’ বণিকদের ঋণ পরিশোধের জন্য ৩ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার দিতে বাধ্য হয়। এর কিছুদিন পর (১৮ই অক্টোবর, ১৮৪৩ খ্রিঃ) বেগ-এর সন্ধি দ্বারা ব্রিটিশরা চিনে কিছু ‘অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার’ (Exta-Territorial Rights) লাভ করে।এর দ্বারা উল্লিখিত সন্ধির আওতাধীন বন্দরগুলিতে বসবাসকারী চিনা ও ব্রিটিশ সব অধিবাসীই ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার অধীনে আসে। বলা বাহুল্য, এর পলে চিনের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়। কেবল এই নয়, নানকিং সন্ধির সূত্র ধরে আমেরিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রাশিয়া, পর্তুগাল, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়।
প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল
প্রথম আফিম যুদ্ধের পরাজয়ের ফল হিসাবে চিনকে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সাথে কতকগুলি অপমানজনক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়েছিল। চিনের ইতিহাসে এই ব্যবস্থা চুক্তি ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এই চুক্তি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে চিন একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগে পদার্পণ করে। চিন একটি “আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক” রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয় এবং তারপর চুক্তি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের ফলে চিনের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়। হংকং ব্রিটিশদের হাতে চলে যাওয়ার ফলে চিনের আঞ্চলিক অখন্ডতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাছাড়া, চুক্তি ব্যবস্থার ফলে চিন বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার অধিকার হারিয়েছিল। চিনে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে “আতি আঞ্চলিক অধিকার” স্বীকার করে নিতে এবং বিভিন্ন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রকে “সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশ”-এর মর্যাদা দিতে চিন বাধ্য হয়েছিল। এ সবই ছিল চিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। ১৮৪২ থেকে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চিনের দুর্বলতার সুযোগ কতকগুলি সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল ৪টি অসম চুক্তি (Unequal Treaty) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে । চুক্তি ব্যবস্থার সূচনার ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিনের নজরানা প্রথার অবসান ঘটেছিল। প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চিনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হযেছিল। আফিমের চোরাই চালান বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রিটিশ অধিকৃত হংকং আফিম চোরাকারবারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় কার্ল মার্কস্ “The Opium Trade” নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন যে, প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধের পর আফিম ব্যবসা দক্ষিণ চিনেও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৮৪০ এর দশকে চিনে আফিমের বাৎসরিক আমদানির গড় পরিমাণ ছিল ৩৭,০০০ পেটি, ১৮৫০ এর দশকে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০,০০০ পেটি। চিনের অভ্যন্তরে আফিমের পাচার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চীনা জনগণের নৈতিক অধঃপতন এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি একই সাথে হতে থাকে। তাছাড়া, বিদেশি বণিকদের কাছে চীনের পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত হওয়ার ফলে এবং বিদেশি পণ্যের উপর অত্যল্প বাণিজ্যশুল্ক ধার্য করতে বাধ্য থাকার ফলে বিদেশি পণ্য চিনের বাজার ছেয়ে ফেলে। বিশেষত, বিদেশি বস্ত্র এবং সুতো চিনের বাজার দখল করে নেয়, ফলে চীনের হস্তশিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। আধুনিক চিনের রূপকার মাও সে তুং তাঁর The Chinese Revolution and the Chinsese Communist Party প্রবন্ধে বলেছেন, “চিনের সামাজিক অর্থনীতি ভেঙে ফেলার ব্যাপারে বিদেশি পুঁজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একদিকে বিদেশি পুঁজি চিনের স্বনির্ভর স্বাভাবিক অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল, অন্যদিকে তা চিনের শবর ও গ্রামাঞ্চলের হস্তশিল্পের ধ্বংস সাধন করেছিল।” সমগ্র চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলে পণ্যনির্ভর অর্থনীতি (Commodity Economy) গড়ে উঠেছিল। প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চিনের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও লুপ্ত হয়েছিল।
প্রথম আফিম যুদ্ধের পরবর্তী চুক্তি অবস্থার মাধ্যমে পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত হওয়ার ফলে চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিদেশি পুঁজিপতিদের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য চিনে এক নতুন সামাজিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .