চিনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিকাশ
প্রথম ও দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধে চিনের শোচনীয় পরাজয় এবং বিশেষত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পিকিং-এর সর্বনাশা সন্ধির পর চিনের বুকে ঘোরতর দুর্দিন নেমে আসে। নানকিং ও টিয়েনসিনের চুক্তি দ্বারা প্রাপ্ত মোট ষোলটি বন্দরে ইউরোপীয় বণিকদের অবাধ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সব বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় তারা নিজ নিজ ‘প্রভাব বলয়’ (Sphere of influence) গড়ে তুলে নিজ নিজ আদালত, প্রশাসন ও পুলিশবাহিনী গঠন করে। কেবল তাই নয় – নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এইসব শক্তি চীন ও তার সন্নিহিত অঞ্চলগুলিতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল উন্মুক্ত হলে এবং সাংহাই বন্দরের সঙ্গে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ চালু হলে তাদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগকে মূলত দুভাবে বিভক্ত করা যায় (১) ১৮৬০ – ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ কালপর্বে তারা চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চিনের প্রভাবাধীন অঞ্চলগুলি দখল করে। (২) ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে চিন-জাপান যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে তারা চিনের অভ্যন্তরস্থ নানা স্থান দখল করে নিজ নিজ প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে থাকে।
১৮৬০ থেকে ১৮৯৮ খ্রিঃ
(১) ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা ব্রহ্মদেশ দখল করে। (২) ফ্রান্স দখল করে কোচিন-চিন, আন্নাম ও টংকিং । (৩) রাশিয়া মঙ্গোলিয়া সীমান্তে ইলি উপত্যকা দখল করে। (৪) জাপান ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লু-চু দ্বীপপুঞ্জ দখল করে কোরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। (৫) ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়াকে কেন্দ্র করে চিন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে জাপানের সঙ্গে শিমনোশেকির সন্ধি (১৮৯৫ খ্রিঃ) স্বাক্ষর করে। সন্ধির শর্তানুসারে জাপান পেস্কাডোরেস, তাইওয়ান, লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার লাভ করে এবং চিনের বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানকে খুলে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাশিয়া, জার্মানী ও ফ্রান্সের চাপে জাপান লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার চীনকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
১৮৯৫ থেকে ১৯০০ খ্রিঃ
জাপানের সাফল্যে ইউরোপীয় দেশগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের ধারণা হয় যে, জাপান একাই হয়ত সমগ্র চিন দখল করে বসবে। তাই চিনের বিভিন্ন অঞ্চল দখলের জন্য তাদের মধ্যে জোর তৎপরতা শুরু হয। (১) ইয়াংসি কিয়াং উপত্যকা ও দক্ষিণ চিনে ইংল্যান্ড (২) শান্টুং, হ্যাং-কাও এবং টিয়েনসিনে জার্মানী (৩) মাঞ্চুরিয়া ও বহির্মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে রাশিয়া (৪) ইউনান, কোয়াং-সি এবং কোয়াং-তুং অঞ লে ফ্রান্স এবং (৫) ফু-কিয়েন অঞ্চলে জাপান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে (৬) এই সব বিদেশী শক্তি চীনের বিভিন্ন অংশে রেলপথ নির্মাণ করে এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন করে। এইভাবে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল দখলের জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সবাই চিনের বিভিন্ন অংশে নিজ নিজ ‘প্রভাবাধীন অঞ্চল’ গড়ে তুলে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় এবং নিজ ‘প্রভাবাধীন অঞ্চলে’ অপরকে বাণিজ্য করতে দিতে আপত্তি জানায়। ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক (Vinacke) এই অবস্থাকে ‘চিনা তরমুজের খন্ডীকরণ’ (Cutting the Chinese melon) বলে অভিহিত করেছেন। খাওয়ার জন্য তরমুজকে যেমন খন্ড খন্ড করে কাটা হয়, পাশ্চাত্য দেশগুলি সেইভাবে চীনকে টুকরো টুকরো করে আত্মসাৎ করে।
উন্মুক্ত দ্বার নীতি
চিনা বাণিজ্যে উৎসাহী হলেও আমেরিকা কিন্তু চিনে রাজ্যাংশ দখল বা ‘প্রভাব বলয়’ গড়ার লড়াইয়ে অগ্রসর হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন শক্তি-কর্তৃক ‘প্রভাব বলয়’ গঠনের ফলে আমেরিকার আশঙ্কা হয় যে, হয়তো চিনের দরজা আমেরিকার কাছে রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব স্যার জন হে চিন সম্পর্কে তার বিখ্যাত উন্মুক্ত দ্বার’ নীতি গোষণা করেন। এই নীতির মূল কথা ছিল এই যে, ইউরোপীয় শক্তিগুলি চিনের যে স্থানই দখল করুক না কেন, চিনের সর্বত্র সব রাষ্ট্রেই বাণিজ্যিক অধিকার থাকবে। এই নীতির লক্ষ্য ছিল চীনে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার স্থলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা স্থাপন। রাশিয়া বাদে সব রাষ্ট্রই এই নীতি মেনে নেয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চিনের অখন্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলে চিন অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .