ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল হরপ্পা সভ্যতায়। বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিই এই নগর সংস্কৃতিকে বেগবাণ করেছিল। বাণিজ্য চলত সিন্ধু উপত্যকার এক প্রান্ডের সঙ্গে অন্য প্রান্তের। হরপ্পার বিস্তৃণ গ্রামাঞ্চল থেকে নগরে কাঁচামাল আসত আর সেই কাচামাল দিয়ে নগরের কারখানায় বিভিন্ন দ্রব্য তৈরী হয়ে সর্বত্র রপ্তানি হত। এই অঞ্চলে যেসব কাঁচামাল উৎপন্ন হত না তা আমদানি করা হত। বর্তমানের কর্ণাটক থেকে সোনা রাজস্থান ও বেলুচিস্তান থেকে তামা এবং গুজরাত থেকে দাবি পাথর সংগ্রহ করা হত।
মেসোপটেমিয়া বা টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস উপত্যকার সঙ্গে হরপ্পাবাসীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন লেখে সে দেশের সঙ্গে তিনটি অঞ্চলের দূরপাল্লার বাণিজ্যের উল্লেখ আছে। এই অঞ্চলগুলি হল তিলমুণ, ম্যাগান ও মেলুহা। তিলমুণ সম্ভবত বাহরিণ কুয়েত; ম্যাগান সম্ভবত ও মাণে অথবা কারো মতে পারস্য উপসাগর বা আরব সাগরের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ছিল। আর মেলুহার অবস্থান সম্ভবত নিন্ম সিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত ছিল।
মেসোপটেমিয়ার লেখে মেলুহা থেকে আগত জাহাজ ও দোভাষীর উল্লেখ আছে। এর থেকে মনে হয় মেসোপটেমিয়াও হরপ্পা অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্য প্রধানত সমুদ্র পথেই চলত। মেলুহা থেকে মেসোপটেমিয়ার কাঠ, তামা, স্বর্ণরেণু, রূপা, ল্যাপিস-লাজুলি, দামী পাথর, হাতির দাঁতে তৈরী সৌখিন দ্রব্য ও চিরুনি, পশু পাখির মূর্তি ও নানা জিনিস রপ্তানি হত। এগুলির মধ্যে একমাত্র ল্যাপিস-লাজুলি ছাড়া বাকি সব দ্রব্য ভারতে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হত। মেসোপটেমীয় বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে সেখান থেকে বহু দ্রব্য পূর্ব দেশগুলিতে রপ্তানি করা হত। এখানে পূর্ব দেশ বলতে সিন্ধু অববাহিকা হরপ্পা অঞ্চলকেই চিহ্নিত করা যায়। মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু অববাহিকার মধ্যে ঘনিষ্ট বাণিজ্যিক সম্পর্কের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও আছে। মেসোপটেমিয়ার ‘ঊর’ও কয়েকটি স্থানে হরপ্পীয় সিলমোহরের অনুরূপ অনেক সিলমোহর পাওয়া গেছে। অনুরূপ ভাবে মোহেনঞ্জোদাড়ো, লোথাল, কালিবঙ্গাল প্রভৃতি স্থানে মেসোপটেমীয় সিলমোহর পাওয়া গেছে। বর্তমানে লোথাল অঞ্চলে বিশাল বন্দরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ভারতীয় বণিকদের একদা উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। বিনিময়ের মাধ্যমেই ব্যবসা বাণিজ্য চলত। তবে হরপ্পাবাসীরা ওজনের ক্ষেত্রে বাটখারা ব্যবহার করত। ৮৭৫০ গ্রাম ওজনের হালকা বাটখারা এবং ১০৯৭০ গ্রাম ভারী বাটখারার প্রচলন ছিল। শুধু বাটখারাই নয় সিন্ধু উপত্যকায় ধাতুর তৈরী কয়েকটি দাঁড়িপাল্লাও আবিষ্কৃত হয়েছে। ধাতু নির্মিত গজকাঠি ও ব্যবহার করত। দেশের ভিতরে ও বাহিরের বাণিজ্যের জন্য হরপ্পাবাসী যানবাহনের দিকেও নজর প্রদান করেছিল। বহির্বাণিজ্যের বেশীর ভাগই চলত সমুদ্র পথে। অনুমান করা হয় আরব সাগর হয়ে পারস্য সাগরের মধ্য দিয়ে তারা মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল ব্যবসা করতে যেত। হরপ্পার অনেক সীলমোহরে জলযানের ছবি উৎকীর্ণ আছে। লোথালে একটি পোড়া মাটির জাহাজের মডেল পাওয়া গেছে। সাধারণত কাঠের তৈরী বড় আকৃতি নৌকার মাধ্যমে এরা ব্যবসা করত। বহু দার ও পালের মাধ্যমে জাহাজ চলত। মেসোপটেমীয় তথ্যেও ‘মেলুহাদের’ জলযানের উল্লেখ আছে।
অন্তর্বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নদী কেন্দ্রিক জলপথ হরপ্পার বণিকরা ব্যবহার করত। স্থলপথে বাণিজ্য পণ্য নেওয়ার জন্য দুই চাকাওয়ালা এক্কা গাড়ি ব্যবহার করত। মালটানার জন্য বলদে টানা গাড়ির ব্যবহার হত। হরপ্পার বণিকরা ব্যবসার উন্নতির জন্য শিল্পী ও কারিগরদের সমাদর করত। বহু লোক ব্যবসা বাণিজ্যেও বিভিন্ন কারিগড়ি শিল্পে নিযুক্ত ছিলেন।
ধাতু ও পাথরের মূর্তি নির্মাণেও হরপ্পার শিল্পীরা দক্ষ ছিলেন। এরা কারিগরি যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র, ধাতু অলংকার, মৃৎপাত্র, পুঁতির গহনা পত্র ব্যাপক হারে তৈরী করত এবং ব্যবসার সামগ্রীরূপে ব্যবহার হত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .