উনিশ শতকের প্রথমার্ধে চিনের কেন্দ্রীয় শাসনব্যস্থা
প্রাক্-আধুনিক চিনে ক্ষমতার সর্বোচ্চস্তরে ছিলেন চিন সম্রাট। চীনে সম্রাটের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করাহত। সম্রাটকে বলা হল ‘স্বর্গের সন্তান’। প্রচলিত ধারণা অনুসারে তিনি প্রকৃতি ও মানব সমাজের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করতেন। স্বর্গের অনুশাসনের (তিয়েন মিং) মাধ্যমে তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। তবে স্বর্গের অনুশাসন অপরিবর্তনীয় ছিল না। রাজকর্মচারীদের দুর্নীতি এবং সম্রাটের অপদার্থতা প্রকট হয়ে উঠলে, সমাজের স্বার্থ সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ করার সীমিত অধিকার চিনা ঐতিহ্যে স্বীকৃত ছিল। এ ধরনের ধ্যানধারণা কনফুসীয় ভাবধারার মধ্যে নিহত ছিল।
চিনা শাসনতন্ত্রে সরকারি কর্মচারীদের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁদের বলা হত ‘ম্যান্ডারিন’ (Mandarin)। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তাঁরাও সম্রাটের সঙ্গে স্বর্গের অনুশাসন লাভের অংশীদার ছিলেন। একজন ম্যান্ডারিনকে শাসনতান্ত্রিক বিষয় সম্পর্কে যত না জানতে হত, তার চেয়ে ধ্রুপদী চিনা ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর অধিকতর জ্ঞান বাঞ্ছনীয় ছিল। ম্যান্ডারিনকে একজন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার ছিল না। কাম্য ছিল তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হবেন।
১৩৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জনৈক মিং সম্রাট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তুলে দিয়ে সচিবালয় বা নেই কো প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল এই সচিবালয়। যাবতীয় রাজকীয় আদেশ এবং ঘোষণা এই সচিবালয় থেকে জনসমক্ষে পাঠানো হত। চিং সম্রাট কাং-শির রাজত্বকালে সচিবালয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহাপরিষদ বা Grand Council গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয়ের গুরুত্ব একেবারে কমে যায়। এই নতুন প্রতিষ্ঠান সচিবালয়ের যাবতীয় রাজনৈতিক এবং সার্বভৌম ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। যে সময় সচিবালয় থেকে ক্ষমতা মহাপরিষদের হাতে চলে যায় সে সময় চিনের সম্রাট ছিলেন ইয়ুং-চেং (১৭২৩-৩৫) । এই মহাপরিষদের সদস্যরা সকলেই ছিলেন সম্রাট ইয়ুং-চেং এর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। সদস্যদের সংখ্যাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। এই সীমিত সংখ্যক সদস্যের পরামর্শ নিয়েই সম্রাট তাঁর শাসনতান্ত্রিক ও সামরিক পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতেন। ইম্যানুয়েল সু বলেছেন – • চিং স্বৈরতন্ত্রের বিকাশে মহাপরিষদ প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্টি এককটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল।
চিনে প্রাদেশিক সরকারগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে ৬টি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। এই ৬টি বোর্ডের সভাপতি ও সহ-সভাপতিরা মহাপরিষদের সদস্য হতেন। তাছাড়া অসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও মহাপরিষদের সদস্য থাকতেন। মহাপরিষদের সদস্যপদ ছিল পুরোপুরি অবৈতনিক। তবে তাঁরা তাদের মূলপদের জন্য বেতন পেতেন। মহাপরিষদের বার্ষিক খরচ ছিল ১০,৫০০ থেকে ১,০০০ টেইল।
মহাপরিষদের সদস্যদের অধীনে ৩২ জন সচিব থাকতেন। এদের মধ্যে ১৬ জন চিনা এবং ১৬ জন মাঞ। নিয়মিত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন এবং সচিবেরা। সচিবদের ‘ক্ষুদে কাউন্সিলর’ বলা হত। চিং শাসনকালে ৩৪ জন সচিব মহাপরিষদের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। চিন সম্রাট সবসময়ই আশা করতেন যে তাঁর মহাপরিষদ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্রুত গ্রহণ করবে, সেই সিদ্ধান্ত যতদূর সম্ভব গোপন রাখবে এবং সম্রাটের সঙ্গে প্রদেশগুলির সম্পর্কে ঘনিষ্টতর করার বাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে।
সচিবালয় এবং মহাপরিষদের পরবর্তী স্তরে ছিল ৬টি বোর্ডের স্থান। এই ৬টি বোর্ড ছিল কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মেরুদণ্ড। এই বোর্ডগুলি ছিল অসামরিক প্রশাসনিক দপ্তর (লি-পু), রাজস্ব দপ্তর (হু-পু), যুদ্ধ সংক্রান্ত দপ্তর (পিং-পু), শাস্তিদান সংক্রান্ত দপ্তর (শিংপু), জনকল্যাণ দপ্তর (কুং-পু) এবং আচার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত দপ্তর (লু-পু)। প্রতিটি বোর্ডে ২ জন সভাপতি এবং ৪জন সহ-সভাপতি থাকতেন। চিনা ও মাঞ্জুদের মধ্যে এই পদগুলি সমানভাবে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বোর্ডের অধীনে ৪টি করে কেন্দ্র থাকত। কেবলমাত্র রাজস্ব দপ্তরের ১৪টি এবং শাস্তিদান সংক্রান্ত দপ্তরের ১৮টি কেন্দ্র ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বৈদেশিক দপ্তর ছিল না। এর প্রধান কারণ ছিল, যে, কনফুসীয় ধারণা অনুযায়ী চিনারা কোনো দেশের সঙ্গে সমপর্যায়ে দাঁড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতী ছিল না। তাই বৈদেশিক দপ্তর রাখার প্রয়োজনীয়তা চিনা কর্তৃপক্ষ অনুভব করেনি।
সচিবালয়, মহাপরিষদ এবং ৬টি বোর্ড এগুলি ছিল চিনের কেন্দ্রীয় শাসনের প্রধান অঙ্গ। কিন্তু এগুলি ছাড়াও কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষাকারী কার্যালয়ের অস্তিত্ব ছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চিং সেন্সরেট। চিং সেন্সরেটে ২ জন প্রবীণ সভাপতি, ৪ জন প্রবীণ সহ-সভাপতি, ২ জন নবীন সভাপতি এবং ৪ জন নবীন সহ-সভাপতি থাকতেন। ৬টি বোর্ডের অধীনে ২৪ জন সেন্সর ছিলেন, আর প্রদেশগুলির জন্য ৫৬ জন সেন্সর থাকতেন। উপরোক্ত পদগুলি চিনা ও মাঞ্জুদের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত ছিল। সেন্সরদের কাজ ছিল সরকারি কর্মচারীদের কাজকর্মের উপর নজরদারি করা। (কেউ কর্তব্য কর্মে অবহেলা করলে, সেন্সররা তা সম্রাটের দরবারে জানিয়ে দিতেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল হানলিন অ্যাকাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল মূলত পড়াশোনা সংক্রান্ত। অ্যাকাডেমির ২ জন চ্যান্সেলর থাকতেন – ১ জন চিনা এবং ১ জন মাঞ। তাঁরা সম্রাটকে বিভিন্ন ধ্রুপদী সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান দান করতেন এবং সম্রাটের বক্তৃতা দেওয়ার বিষয় লিপিবদ্ধ করে দিতেন। হানলিন অ্যাকাডেমির অধীনে একটি চমৎকার গ্রন্থাগার ছিল। মূল্যবান পুস্তক ছাড়াও নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও স্মৃতিকথা এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকতে।
হানলিন গ্রন্থাগারের অধীনে রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিকরে কার্যালয় ছিল। ঐতিহাসিকরা প্রত্যেক সম্রাটের রাজত্বকালের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতেন এবং রাজত্বকালে সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষিত রাখতেন। তাছাড়া ঐতিহাসিকরা সম্রাট, সম্রাজ্ঞী ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের জীবনীও লিখতেন। কেবলমাত্র মেট্রোপলিটন সাম্মানিক স্নাতকরাই অ্যাকাডেমির সদস্য হতে পারতেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন ভালো ছাত্র। অ্যাকাডেমিতে সাফল্যের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার পর অনেক সময়ই তাদের পদোন্নতি ঘটত। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উচ্চতম স্তরে অ্যাকাডেমির অনেক সদস্যই উন্নীত হয়েছিল।
বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিনের আইন প্রণীত হয়েছিল। মাঞ্জুদের শাসনকালে বিশেষ অপরাধের জন্য বিশেষ ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। বিচারকার্য পরিচালনার সময় সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। বিচার প্রার্থীদের মধ্যে কে সঠিক এবং কে ভ্রান্ত – সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া হত না। সামাজিক শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং সম্রাটের কর্তৃত্বে বিরোধিতা সব থেকে বড়ো। অপরাধ বলে গণ্য করা হত। মৃতুদণ্ডের প্রচলন ছিল। এর পরবর্তী স্তরের শাস্তি ছিল নির্বাসন। শাস্তি হিসাবে দৈহিক অত্যাচার স্বীকৃত ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সন্দেহভাজন ব্যক্তির পরিবার ভুক্ত কোনো সদস্যকেও দৈহিক নির্যাতন করা হত। নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার বিষয়টির থেকে সমাজের কল্যাণের দিকে অধিকতর নজর রেখে চিনে আইন ও দণ্ডব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছিল। তবে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ভাবে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দায়ের করার অধিকার ছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .