বিদেশী বৃত্তান্তকে প্রাচীন সাহিত্য প্রত্নতত্ত্ব, মুদ্রা বিজ্ঞান, লেখবিদ্যা প্রভৃতির পরিপূরক হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেক গ্রীক রোমান এবং চীনা পরিব্রাজক ভারতে এসেছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই শুধুমাত্র পর্যটক হিসাবে আসলেও অনেকেই ভারতীয় সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে এদেশের বহু ঐতিহ্যকে তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিছু বিদেশী আলেকজান্ডারের সাথে এসেছিলেন আবার বেশ কয়েকজন এসেছেন তার পরে দূত হিসাবে।
মেগাস্থিনিস মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় দূত হয়ে এসেছিলেন। “ইন্ডিকা” তার লিখিত গ্রন্থ। এর সম্পূর্ণ গ্রন্থ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু পরবর্তীকালের বিদেশী লেখকগণ তাদের রচনায় এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এই উদ্ধৃতিগুলি একত্রে পাঠ করলে মৌর্য যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। এদেশে ক্রীতদাস প্রথা নেই বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র নগরীর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংগঠনের বর্ণনা পাওয়া যায়।
গ্রীক ভাষায় লিখিত অপর গ্রন্থ হল “পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী”। ১০০ খ্রীঃ কোন এক অজ্ঞাত পরিচয় বণিক এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সমুদ্র বাণিজ্যের নির্দেশিকারূপী এই গ্রন্থে ভারতীয় বন্দরগুলিতে কোন দ্রব্যের চাহিদা ছিল ও বিনিময়ে বাইরে কী পাঠান হত তার তালিকা পাওয়া যায়।
প্লিনির ন্যাচারালিস হিস্টোরিকা খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের রচনা। এটি ল্যাতিন ভাষায় লিখিত। এর থেকে আমরা ভারত ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে যে বাণিজ্য চলত সে সম্পর্কে জানতে পারি। প্লিনি তার গ্রন্থে ক্ষেদের সাথে উল্লেখ করেছেন যে ভারতের সাথে বাণিজ্য করে রোম নিজের স্বর্ণভান্ডার হারাচ্ছে।
চীনা পরিব্রাজকদের মধ্যে ফা-হিয়েন হিউয়েন সাঙ দুজনেই ছিলেন বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলি পরিদর্শন ও বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে তারা ভারতে আসেন। ফা হিয়েন আসেন খ্রীস্টিয় পঞ্চম শতকের প্রথমদিকে এবং হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে।
ফা-হিয়েন গুপ্ত যুগের ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক ও বিশেষ করে বৌদ্ধ হওয়ার জন্য ধর্মীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। প্রায় ১৫ বছর এদেশে ছিলেন। তার মানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন এবং এদেশের ক্ষেত্রে তাঁর লেখনি বাস্তবানুগ হয়েছে। তার রচিত গ্রন্থের নাম ফো-উ-কি।
হর্ষবর্ধনের যুগে ভারতে এসেছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ। তিনি প্রায় সারা ভারত পরিভ্রমণ করেছেন। কোথায় কোথায় বৌদ্ধ মঠ ছিল ও কোন স্থানে কোন কোন জনপদ ছিল এই সব তথ্য পাওয়া যায় তার রচিত বৃত্তান্ত। কিন্তু তাঁর লেখায় সমদর্শিতা নেই আছে রাজার প্রতি পক্ষপাতিত্ব।
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস রচনায় ৬০৮-৯০৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চিনা পর্যটকদের লেখা গ্রন্থগুলি অপরিহার্য। তারা বৌদ্ধধর্মের আচার বিচার, রীতি-নীতি সংঘ সম্প্রদায় এবং সাহিত্য দর্শন সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ভারতবর্ষ থেকে তারা অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ সংগ্রহ করে চিনে নিয়ে যান। আবার অনেক মূল সংস্কৃত, পালি প্রাকৃত গ্রন্থ তারা চিনা ভাষা অনুবাদ করেছিলেন।
খ্রীস্টিয় সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ই-চিঙ্গ ভারতে আসেন। তাঁর বিবরণ থেকেও ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে অবগত হওয়া যায়। ১২২৫ খ্রীঃ লিখিত চৌস জু, কুঙার গ্রন্থে ভারতীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। একাদশ শতকে থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সেই তথ্য এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
লামা তারনাথ ১৫৭৩ খ্রীঃ তিব্বতে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৬০৮ খ্রিঃ তিনি তার ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস” নামে বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। পূর্ব বাংলার চন্দ্র এবং পাল রাজাদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত সকল বৌদ্ধ গ্রন্থের বিষয়বস্তু তাঁর গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .