প্রাচীন চিনের অর্থনীতি
প্রাচীন কনফুসীয় ঐতিহ্য অনুসারে চিনদেশে একটি কথা প্রচলিত ছিল। কথাটির অর্থ – কৃষির প্রতি মর্যাদা দেখাও, বাণিজ্যকে ঘৃণা কর। এ কথার থেকে বোঝা যায় যে প্রাক্-আধুনিক চিনে বাণিজ্য যথেষ্ট অবহেলিত ছিল। কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়া হত। অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে চিনে হস্তশিল্প ও মাঝারি দূরত্বের বাণিজ্য দৈনন্দিন আর্থিক জীবনে কিছুটা স্থান করে নিতে পেরেছিল।
উনিশ শতকে চিনের অর্থনীতি ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। সমগ্র জনসংখ্যার পাঁচভাগের চারভাগ কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রচুর পরিমাণে এবং বিভিন্ন ধরনের শস্য চিনে উৎপাদিত হত। দক্ষিণ ও মধ্য চীনে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপন্ন হত। উত্তর চীনে উৎপন্ন হত গম, ভুট্টা, চা, সয়াবিন, বাদাম ইত্যাদি শস্য। তাছাড়া তুঁত, তুলা শন, তৈল উৎপাদনকারী নানা ধরনের চারা ইত্যাদি চাষেরও প্রচলন ছিল চিনে। উপরোক্ত শস্যগুলি হস্তশিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। চিনের বনাঞ্চলে নানা ধরনের বন্য বৃক্ষের অস্তিত্ব ছিল। এই সমস্ত বৃক্ষ থেকে বার্ণিশ, ওষুধ ইত্যাদি তৈরি হত। চিনের কৃষি ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি শ্রমনির্ভর (Labour intensive)। কৃষির ওপর এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা সত্ত্বেও মাঞ্জু শাসনাধীন প্রাক্-আধুনিক চিনে কৃষির তেমন উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটেনি। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫৪৯ মিলিয়ন মৌ। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে আবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছিল মাত্র ৭৪১ মিলিয়ন মৌ।
রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি-রাজস্ব এবং মাথট কর (Poll Tax)। তাছাড়া লবণের উপর কর, চায়ের উপর কর, বাণিজ্যিক লাইসেন্সের উপর কর ইত্যাদি থেকেও রাষ্ট্রের আয় হত। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ভূমি থেকে আসা কর। সমগ্র রাজস্বের ৭৫ শতাংশ আসত ভূমি রাজস্ব থেকে। এর থেকেই রাজপ্রাসাদের খরচ, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় এবং সোনাবাহিনীর খরচ চালানো হত। ফলে অনেক সময়ই কৃষকদের ওপর চরম উৎপীড়ন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা হত। অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকেরা ইয়ামেন (Yamen) বা স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রের কর্মচারীদের অসততা ও মিথ্যাচারের শিকার হতেন। তাম্রমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে মূল্যের ঘনঘন পরিবর্তনের ফলে অশিক্ষিত কৃষকদের প্রতারণা করা অত্যন্ত সহজ ছিল।
অষ্টাদশ শতকের অন্তিমলগ্ন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে নগদ টাকায় কর দেওয়া যেত। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, তৎকালীন চিনে নগদ টাকার ওপর ভিত্তি করে একটি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কর ভারে জর্জরিত থাকার ফলে এবং সরাসরি কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অত্যাচারের শিকার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চিনে কৃষকদের অত্যন্ত দরিদ্র জীবনযাপন করতে হত। তার ওপর খরা, বন্যা, মহামারী ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্বিপাক প্রায়ই চাষের ক্ষতি করত। ফলে কৃষকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হত, কারণ রাজকর্মচারীরা সময়মতো রাজস্ব আদায় করতে ছাড়তেন না। পিকিং এর রাজদরবারে কৃষকদের অসন্তোষের খবর পৌঁছলে অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করত। কিন্তু খবর সব সময় পৌঁছাত না। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি কৃষকদের বিক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলেছিল, যার অনিবার্য পরিণতি ছিল একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .