হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব
হর্ষবর্ধন তথা সপ্তম শতাব্দীতে উত্তর ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ১) হিউয়েন সাং এর বিবরণী, ২) বাণভট্টের রচিত হর্ষচরিত, ৩) মধুবণ লিপি, ৪) সোনপত লিপি ৫) বাণক্ষের লিপি ৬) সমসাময়িক মুদ্রা ৭) গঞ্জাম লিপির উপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করতে হয়।
হর্ষবর্ধন পুষ্যভৃতিবংশের নৃপতি ছিলেন। এই বংশের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বাণভট্টের বিবরণ অনুসারে রাজা পুষ্যভূতি ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রভাকর বর্ধন ছিলেন (৫৮০ – ৬০৫ খ্রীঃ) এই বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা। তারপর তাঁর পুত্র রাজ্যবর্ধন (৬০৫ – ৬০৬ খ্রীঃ) রাজা হলেন। গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্কের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রে তিনি ৬০৬ খ্রীঃ নিহত হন। এর ফলে থানেশ্বরের রাজা হলেন প্রভাকর বর্ধনের দ্বিতীয় পুত্র হর্ষবর্ধন। তিনি ছিলেন উত্তর ভারতের শেষ সম্রাট। ৬০৬ খ্রীঃ তিনি থানেশ্বরের রাজা হলেন।
শশাঙ্কের ষড়যন্ত্রে ইতিমধ্যে মৌখরী রাজ গ্রহবর্মনের মৃত্যু হয়। তার ফলে কনৌজের সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়লে কনৌজের অমাত্যদের অনুরোধে হর্ষবর্ধন মৌখরী রাজ্যের শাসনভারও গ্রহণ করেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ৬০৬ খ্রীঃ তিনি “হর্ষ সম্বৎ” নামে একটি অব্দ প্রচলন করেন। ৬১২ খ্রীঃ হর্ষবর্ধন “রাজপুত্র” উপাধি গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যেই থানেশ্বর ও কনৌজকে একত্রিত করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে তিনি শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ইতিমধ্যে বিন্ধ্যপর্বতের নিকটবর্তী অরণ্য থেকে বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন এবং মন্ত্রী “ভান্ডি” কে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধের কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। বাণভট্টের হর্ষচরিত হতে কেবলমাত্র হর্ষবর্ধন কর্তৃক শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধের কথা জানা যায়। কিন্তু তিনি ও এর কোন বিস্তৃত বিবরণ লেখেন নাই। যতদূর মনে হয় শশাঙ্ক তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত মগধের উপর আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। আনুমানিক ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পর হর্ষবর্ধন “মগধ” কে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন।
সম্ভবত ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পরেই হর্ষবর্ধন পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব বঙ্গ অধিকার করেন। অল্পদিনের মধ্যে কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মনকে পরাজিত করেন। এইভাবে হর্ষবর্ধন উড়িষ্যার গঞ্জাম পর্যন্ত অধিকার করেন। এই খানেই তিনি একটি বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান করেন। জনশ্রুতি আছে নালন্দার পন্ডিত জয়সেনকে আমন্ত্রণ করেন এবং সম্মেলন শেষে উড়িষ্যার ৮০ টি জনপদের রাজস্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করেছিলেন।
দক্ষিণ ভারতের চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্ভবত ৬৩৪ খ্রীঃ এই যুদ্ধ হয়েছিল এবং দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করেছিলেন এবং এই বিজয়কে স্মরণীয় রাখার জন্য তিনি “পরমেশ্বর” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
পরিশেষে বলা যায় সিন্ধুদেশ ও কাশ্মীরের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযান করেছিলেন। তবে তার বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। যাই হোক তিনি উত্তরাপথের সর্বাধিনায়ক বলে অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাসম্পন্ন রাজা। তিনি সকল সময় সামরিক প্রতিভা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেন নাই। তার প্রমাণ হল তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল।
অনেকে হর্ষবর্ধনকে প্রাচীন যুগের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্যের-স্রষ্টা বলে পরিচিত করেছেন। কারণ তিনি উত্তর-ভারতের অখন্ডতা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন, চীন ও পারস্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর সময় স্মরণীয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .