Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

স্বদেশি আন্দোলনের তাৎপর্য আলােচনা করাে।

স্বদেশি আন্দোলনের তাৎপর্য

লর্ড কার্জন ছিলেন একজন প্রতিক্রিয়াশীল গভর্নর জেনারেল। তার সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ হল বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের ফলেই বয়কট ও স্বদেশি নামক দুই কার্যপন্থাকে অবলম্বন করে সমস্ত বাংলায় যে উত্তাল জাতীয় সংগ্রাম শুরু হয় তা স্বদেশি আন্দোলন নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আন্দোলনকে আত্মশক্তির আন্দোলন বা গঠনমূলক স্বদেশি আন্দোলন বলা হয়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব সামগ্রিকভাবে জাতীয় আন্দোলনে পড়েছিল। ছাত্র-যুব আন্দোলনে এর বলিষ্ঠ প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বয়কটের মতাে অর্থনৈতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার কৃতিত্ব স্বদেশি আন্দোলনের চরমপন্থী নেতাদের প্রাপ্য। এই আন্দোলনের সময় জাতীয় স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে স্থাপন করা হয়।

রাজনৈতিক

স্বাদেশি আন্দোলন ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক প্রাণচঞ্চল অধ্যায়ের সূচনা করে। ইতিপূর্বে আর কখনাে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এতটা গতিশীল ও প্রাণবন্ত রূপ ধারণ করেনি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় এই সকল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে প্রথম গতিশীল সংগ্রামমুখী আন্দোলনের সূচনা হয়। ভারতীয় জাতীয় সংগ্রাম বৈঠকি রাজনৈতিক স্বল্প পরিসর থেকে মুক্ত হয়ে সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রসারলাভ করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই সত্য জাতীয় হৃদয়ে জেগে ছিল যে, ইংরেজ ও ভারতবাসীর স্বার্থ পরস্পর বিরােধী। স্বদেশি আন্দোলনের গঠনমূলক কর্মসূচি পরবর্তীকালে অসহযােগ আন্দোলনের বাতাবরণ প্রস্তুত করেছিল। এই আন্দোলনের তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধি বলেছেন—“বঙ্গভঙ্গের পরেই ভারতের প্রকৃত নবজাগরণ ঘটেছে—এই বঙ্গ বিভাগই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিভাগের কারণ হবে”।

অর্থনৈতিক

স্বদেশি আন্দোলনের ফলেই স্বদেশি দ্রব্য প্রস্তুত ও প্রসার বৃদ্ধি পায়। স্বদেশি ভাবধারায় অনেক কাপড়ের কল, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ কারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ড. নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বেঙ্গাল ন্যাশনাল ব্যাংক ও ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষা

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও স্বদেশি আন্দোলন জাতীয় শিক্ষার প্রসার করণে সহায়তা করে। সতীশচন্দ্র মুখার্জী ডন সােসাইটি স্থাপন করে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের পথ দেখান। অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালে ব্রজমােহন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

স্বদেশি আন্দোলন সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এক নতুন উদ্দীপনা ও প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। অধ্যাপক সুমিত সরকারের ভাষায় “No other phase our National movement can boast of a cultural accompaniment as rich as Swadeshi.” বস্তুত স্বদেশি আন্দোলনের ফলে বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নবজাগরণ আসে। এই সময় অসংখ্য কবিতা ও গানের মাধ্যমে দেশপ্রেমের বাণী চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের কতকগুলি বিখ্যাত গান “আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি”, “বাংলার মাটি বাংলার জল”, “যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে” এই সময় রচিত হয়। রজনীকান্ত সেনের “মায়ের দেওয়া মােটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই”, মুকুন্দ দাসের “ওগাে বঙ্গ নারী, ফেলে দাও রেশমী চুড়ি” প্রভৃতি গানও রচিত হয়। উপন্যাস, নাটক ও ছােটোগল্পের মধ্যেও স্বদেশি যুগের প্রভাব লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ ও ‘গােরা’ এই যুগের পটভূমিতে রচিত হয়। প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়ের ‘খালাস’, ‘উকিলের বুদ্ধি’, ‘হাতে হাতে ফল’ প্রভৃতি এই যুগের সমস্যার ওপর রচিত। প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও স্বদেশি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আত্মশক্তি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘স্বদেশ শিক্ষা’, প্রমথ চৌধুরি রচিত ‘স্বদেশীতা’, ‘তেল-নুন-লকড়ী’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

সীমাবদ্ধতা

এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাও ছিল। এই আন্দোলনকে অনেকেই “Elitist” বলে মনে করেন। রজনীপাম দত্ত স্বদেশি আন্দোলনকে বুর্জোয়া আন্দোলন বলতে চান, যা কখনাে কখনাে গণ আন্দোলনের চরিত্রও নেয়। তার মতে স্বদেশি আন্দোলনকে হিন্দু জাগরণবাদ সীমাবদ্ধতা দেয় এবং প্রগতিশীল ভারতীয় জাতীয় সংহতির আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রুশ গবেষক কুমারভ এই আন্দোলনকে পাতি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেছিলেন।

কিন্তু সুমিত সরকার মনে করেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে যে প্রচলিত। মার্কসবাদী ‘Elitist’ আখ্যা দেওয়া হয় তা ত্রুটিপূর্ণ। আদর্শবাদের স্থলে অর্থনৈতিক স্বার্থকেই বড়াে করে দেখা হয়েছে, যা ঠিক নয়। এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ও গৌরবময় ঐতিহ্য রেখে গিয়েছে। এখানেই স্বদেশি আন্দোলনের সার্থকতা।

Leave a reply