লিঙ্গ রাজনীতি (Gender Politics)
Gender শব্দটির সঙ্গে সাধারণভাবে জৈবিক লিঙ্গের ধারণা জড়িত। কিন্তু বর্তমান সামাজিক পটভূমিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে লিঙ্গগত পার্থক্যের সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি নির্দিষ্ট পার্থক্য সংযুক্ত হয়। সিমন্তি সেনের মতে, সমাজতত্বে Gender শব্দটি শুধুমাত্র লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাগকে বোঝায় না, Gender এর অর্থ হল জৈবিকতার অতিরিক্ত এবং পৌরুষ বা নারীত্ব কোনো জৈবিক সত্য নয়। এ হল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। সমাজবিকাশের ধারায় প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে নারীত্ব ও পুরুষত্বের ধারণা আলাদা আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত হয়। যা একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এর ফলে নারী ও পুরুষ নিজেদের শরীরের সঙ্গে গুণগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক তৈরী করে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মূল ধারণা ছিল মাতৃত্ব ও তাই নারীর সংজ্ঞা ছিল মাতা। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে নারী হল আবদ্ধ গৃহবধূ। এবং পুরুষ তার অন্নদাতা, তাই এই সমাজে নারী জাতির উপর আধিপত্যের ধারণা তাত্ত্বিক রূপ লাভ করে।
রাজনীতির মুখ্য বিষয় হল ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য। মানব সমাজের ইতিহাসে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বিলুপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়।
ধর্ম ও Gender রাজনীতি
ধর্ম হল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যার মাধ্যমে Gender রাজনীতি বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকরী করা হয়। সনাতন হিন্দুধর্মে নারীকে অভিশাপ হিসাবে গণ্য করা হয়। ইসলাম ও ক্যাথলিক ধর্মে নারীর স্বতন্ত্র মর্যাদা স্বীকার করা হয়না। সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থা নারীজাতীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে রক্ষা করার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।
আর্থিক বৈষম্য ও Gender রাজনীতি
অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সম্পদের বণ্টনের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বা Gender রাজনীতি বহিঃপ্রকাশের অন্যতম নিদর্শন। অধিকাংশ সমাজে সম্পত্তি পুরুষের মালিকানার অন্তর্গত। সম্পত্তি ও আয়ের ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে বৈষম্য নারীজাতিকে এক শোষিত শ্রেণীতে পরিণত করে। নারী পরিবারের মধ্যে সন্তানের জন্ম থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত সে শ্রমদান করে, তার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলিতে নারী ও পুরুষকে সমান কাজের জন্য সমান মজুরী দান এখনো করা হয়না।
রাজনৈতিক সংগঠন ও Gender রাজনীতি
রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে যখন পুরুষের আধিপত্য এবং নারী পুরুষের বৈষম্য কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়। এর ফলে Gender রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে। নারীবাদী দার্শনিক সাইমন ভি. বভয়ের মতে, “One is not born a woman, becomes a woman”. এর অর্থ হল—জন্মগ্রহণের পর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আধিপত্যহীন অবস্থা থেকে নারী সৃষ্টি হয়। পুরুষের আধিপত্য, মতাদর্শ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। মানবসমাজে এইভাবে Gender রাজনীতির বহিঃপ্রকাশকে বিভিন্ন দিক থেকে উল্লেখ করা যায়।
পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও Gender রাজনীতি
নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে বজায় রাখার সামাজিক কৌশল হল পিতৃতন্ত্র। কমলা ভাসিন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্ম একাধিক পদ্ধতি চিহ্নিত করেন। নারীর বাড়ির কাজ ও বাইরের কাজ উভয়ই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাড়ির মধ্যে নারী যে কাজ করে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। শ্রমের মতো প্রজনন ক্ষমতাও পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবারের কয়েকটি সন্তান কাম্য পরিবার পরিকল্পনা সবই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষের দ্বারা। নারীর মতামত-এর কোনো গুরুত্ব নেই। সমাজে নারী হল পুরুষ এর যৌন তৃপ্তির উপায়মাত্র। শুধুমাত্র তাকে ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখা হয়। সামাজিক ও পারিবারিক দৈহিক সমস্ত ক্ষেত্রেই নারীর স্বাধীনতাকে সুকৌশলে দমন করে রাখা হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভা থেকে শুরু করে স্বায়ত্বশাসন মূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে পুরুষের ন্যায় নারীর অংশগ্রহণের হার সমান নয়। আইন, শাসন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যান্য দিক পুরুষের কর্তৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়।
গণমাধ্যম বা Gender রাজনীতি
Gender রাজনীতির বহিঃপ্রকাশের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গণমাধ্যম। সংবাদপত্র থেকে দূরদর্শন সর্বত্রই পুরুষের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞাপনে ও চলচিত্রে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হয়।
এছাড়াও মানবসমাজের জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নারীর উপেক্ষিত। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীদের অধিকারকে এখনো স্বীকার করা হয়না। তবে, সাম্প্রতিককালে বিশ্বে উন্নত দেশগুলিতে নারীর অধীনতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক সচেতন প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে Gender রাজনীতির গুরুত্ব নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
Read More
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .