ভারতীয় সমাজে পিতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় লিঙ্গ বৈষম্য
লিঙ্গ বৈষম্য বলতে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে শুধুমাত্র জৈবিক ও শারীরিক পার্থক্যকেই বোঝায় না। অনাদি কাল ধরে ভারতীয় সমাজে কন্যা সন্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই পরিবারে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে রয়েছে। কন্যার জন্মকে পরিবারে বোঝা বলে মনে করা হয়। পুত্রের জন্মকে পরিবারের পক্ষে শুভ বলে মনে করা হয়। পরিবারে পুত্র জন্মের প্রতি অনুরাগ থেকেই বৈষম্যের লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে থাকে। কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তানকে কেন্দ্র করে সমাজে যে বৈষম্যের সূত্রপাত হয় তা সারা জীবন ধরে চলতেই থাকে। পরিবারের কন্যা সন্তানদের একদিকে যেমন সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়, অপরদিকে তেমনি তারা সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। উভয় লিঙ্গের মধ্যে এই বৈষম্যকেই লিঙ্গ বৈষম্য (Gender Discrimination) বলে ।
‘লিঙ্গ (Gender)’ একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক শব্দ যে শব্দের দ্বারা সমাজে নারী ও পুরুষকে তাদের প্রদত্ত ভূমিকা পালনের কথা বলা হয় ও তাদের পৃথক আচার-আচরণের ভূমিকাকে বোঝান হয়। ‘লিঙ্গ (sex) শব্দের দ্বারা জৈবিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে বোঝান হয়। যাতে মনুষ্য সমাজে নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গকেই বোঝান হয়ে থাকে।
স্বাভাবিকভাবে সমাজ সৃষ্ট লিঙ্গের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক ও ভূমিকার মধ্যে একটি দেওয়াল তুলে দেওয়া হয় যার প্রতিফলন ঘটে সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, সম্পত্তির মালিকানার অধিকারে এবং পরিবার ও সমাজে যে-কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে জৈবিক ও শারীরিক দিক থেকে এবং উভয়ের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তাতে সমাজে নারী উভয় দিক থেকেই দুর্বল। নারীকে সমাজে পুরুষের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয়। এরজন্যই নারী ভারতীয় সমাজে চিরকাল শোষিত হয়ে আসছে, পুরুষদের হিংসার শিকার হচ্ছে, অবমানিত হচ্ছে। নারী-পুরুষের সম্পর্কে অসাম্য দেখা দিচ্ছে।
ভারতীয় সংবিধান নারী ও পুরুষ উভয়কে তাদের অবস্থার উন্নয়নে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতি দিলেও সমাজে নারীদের কোনও ন্যায়সঙ্গত মর্যাদা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতের অধিকাংশ নারী এই সব অধিকার লাভে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এর মূলে রয়েছে সমাজের সনাতন মূল্যবোধ যে মূল্যবোধ থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে, ঘর-গৃহস্থালীর কাজে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে নিযুক্ত করে রেখেছে। ফলে উপযুক্ত পথনির্দেশ না পেয়ে তাঁদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার, চেতনার ও উন্নতির অভাব পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। যে-সমস্ত কারণে ভারতীয় সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
(ক) দারিদ্র্য :
বর্তমানে ভারতে ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মহিলা। এর কারণ মহিলাদের সামনে কোনওরূপ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেই। অর্থনৈতিক সম্পদে তাঁদের কোনও অধিকার নেই, আইন থকালেও পরিবারের ভূ-সম্পত্তির মালিকানা থেকে তারা বঞ্চিত হন, শিক্ষার সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। এমনকি, পরিবারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। স্বাধীনতার উপার্জন করার ক্ষেত্রে রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক বিধিনিষেধ।
(খ) নিরক্ষরতা :
সমগ্র বিশ্বজুড়ে বুনিয়াদি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতে এখানো ২৮ কোটি ৭০ লক্ষ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিরক্ষর রয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার দুই তৃতীয়াংশ মহিলা। নারীদের মধ্যে শিক্ষার অনগ্রসরতার ফলেই তারা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যান বিচার করলে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার হারে অসাম্যের তথ্য থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়।
(গ) কর্মে নিযুক্তির সুযোগের অভাব :
বিশ্বায়নের পর নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মহিলাদের সামনে ঘর ছেড়ে বাইরে কর্মে নিযুক্তি হওয়ার অনেক সুযোগ সৃষ্টি হলেও তাঁরা পুরানো ঘর-গৃহস্থালীর গণ্ডি ছেড়ে তার সুযোগ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ভেবে ‘উঠতে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। বহু দিন থেকে ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মহিলারা তাঁদের জীবনের বেশির ভাগ সময় যেভাবে ঘর-গৃহস্থালীর কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাতে তাঁদের পক্ষে হঠাৎ সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়তে হয় যদিও তাঁরা ভালভাবে জানেন সেই কাজে কোনও পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না।
ঘর-গৃহস্থালীর কাজে প্রথাগত শ্রম বিভাজন ও গৃহকর্তার নিষেধ বাইরে কাজের সন্ধানে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এ-ছাড়া মহিলাদের সন্তান ধারণ ও সন্তানদের প্রতিপালনের জন্য বহু সময় অতিবাহিত করতে হয়। এর ফলে নিজেদের কাজের উপযুক্ত করে তোলার জন্য যে দক্ষতা লাগে তা তাঁরা অর্জন করতে পারেন না। দীর্ঘ সময় ঘরের বাইরে থেকে কাজ করে যাওয়াও তাঁদের পক্ষে বাস্তবে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এজন্য ভারতের মহিলারা অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের সাবলম্বী করে তুলতে পারেন না। ফলে তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় যাকে লিঙ্গ বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
(ঘ) সমাজিক প্রথা, বিশ্বাস ও আচার-আচরণ :
ভারতের নারী সামাজিক প্রথা, চিরাচরিত বিশ্বাস ও সামাজিক আচার-আচরণের ঊর্ধ্বে নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাদের গৃহবন্দি করে রাখে। বাড়ির পুরুষদের পরিবারের প্রধান প্রতিপালক ও রক্ষা কর্তা বলে ভাবা হয়। মহিলাদের সংসারে শুধু সহায়কের ভূমিকা পালন করে যেতে হয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সুদূর অতীত কাল থেকে সমাজে এই ধরনের প্রথা চলে আসছে।
সনাতন ভারতীয় সমাজে পরিবারে পুত্র সন্তানের জন্মকে অগ্রাধিকার ও কন্যা সন্তানের জন্মকে অবজ্ঞা করা হয়। সমাজ ও পরিবারে এ-যুগেও এই ধরনের মানসিক জটিলতা সমানে চলে আসছে। ভারতীয় সমাজে মহিলাদের জন্য নানাবিধ শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। কন্যার জন্ম পরিবারে দায় স্বরূপ বলে বিবেচিত হয়। কারণ, তাকে বিয়ে দিতে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বরপক্ষকে মোটা টাকা পণ হিসেবে দিতে হয়। সুতরাং, কন্যার জন্মকে পরিবারে ভাল চোখে দেখা হয় না। বরং, বলা যেতে পারে নারীদের সামাজিক দিক থেকে অপাঙ্ক্তেয় করে পুত্রসন্তানের উপর পক্ষপাতিত্ব দেখানো অবশ্যই লিঙ্গ বৈষম্যতা।
এই ধরনের বিচিত্র গোঁড়া মানসিকতা বর্তমান আধুনিক যুগেও সমাজে সমান মাত্রায় উপস্থিত রয়েছে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে কোনও নারী অস্তসত্তা হলে গৃহকর্তা শিশু জন্মবাবার আগেই গর্ভবতী নারীর ভাবী সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে সচেষ্ট হন এবং লিঙ্গ পরীক্ষায় যদি দেখা যায় গর্ভবতী নারীর গর্ভে কন্যাসন্তান রয়েছে তবে গর্ভপাত ঘটাতে দ্রুত অগ্রসর হন যা বর্তমান আইনে সম্পূর্ণরূপে বেআইনি।
পশ্চাদপদ শ্রেণীর অনেক পিতা-মাতা রয়েছেন যারা কন্যাদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে তাদের ঘর-গৃহস্থালীর কাজে শিক্ষা দিতে বেশি আগ্রহী। তারা মনে করেন কন্যসন্তানের জন্য শিক্ষাখাতে ব্যয় করার আর্থিক দায় তারা নিতে চাননা। কন্যা বড় হলে তাকে তো বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতেই হবে। এই গোঁড়া চিন্তা-ভাবনা প্রসারের আহার সমাজে নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এবং তাতে লিঙ্গ বৈষম্যের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(ঙ) সামাজিক মনোভাব :
সমাজে মহিলাদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে ও তাদের সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে দেশের বহু সমাজকর্মী ও সমাজ সংস্কারকগণ নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, এখনো পর্যন্ত গ্রামীণ সমাজের বহু মানুষের মনোভাবে কোনও পরিবর্তন আসেনি বললেই চলে। সমাজ উন্নয়নে বহু সরকারী ও বেসরকারী পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি সমগ্র দেশ জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও আমাদের দেশের নারী সমাজ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত তারা পূর্বের ন্যায় শোষিত হয়ে চলেছে, অন্ধ কুসংস্কার নিয়ে বেঁচে আছে। নিরক্ষরতা তাদের আধুনিক চিন্তা-ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, প্রতিদিন তারা সামাজিক নৃশংসতার শিকারে পরিণত হচ্ছে।
(চ) মহিলাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব :
সমাজের বেশির ভাগ মহিলা তাঁদের মৌলিক অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি, তাঁরা এও জানেন না কীভাবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি দিনের পর দিন তাঁদের চরম ক্ষতির পথে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁরা সচেতন না হওয়ার ফলে বিনা দ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে পুরুষ শাসিত সমাজে তাঁদের প্রতি যে বৈষম্য দেখান হচ্ছে বা সৃষ্টি করা হচ্ছে তা তাঁরা মেনে চলেছেন। এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে তা অনুসন্ধান করে জানা গেছে অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই এর মূল কারণ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .