লিঙ্গবৈষম্য ও রাজনীতি
কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও ক্ষমতা যদি রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়, তাহলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বিলুপ্ত হবার পর থেকেই লিঙ্গরাজনীতির আবির্ভাব হয়েছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য কৃত্রিম ভাবে করা হয়। নারীবাদী দার্শনিক সাইমন ডি বভয়ের মতে, ‘one is not born a woman, becomes a woman’ অর্থাৎ ‘একজন মহিলা হয়ে জন্মায় না, একজন মহিলায় পরিণত হয়।
এর অর্থ হল জন্মগ্রহণের পর আধিপত্যহীন অবস্থান থেকে নারী সৃষ্টি হয়। পুরুষের আধিপত্য, মতাদর্শ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সমতায়নের প্রচেষ্টা হল লিঙ্গরাজনীতি।
লিঙ্গরাজনীতির বহিঃপ্রকাশগুলির বর্ণনাগুলি হল নিম্নরূপ :
(১) পিতৃতান্ত্রিক অবস্থা ও রাজনীতি
লিঙ্গরাজনীতির কর্তৃত্বমূলক ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বহিঃপ্রকাশ পিতৃতন্ত্রে ঘটে থাকে। কমলা ভাসীন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলি চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমত: বাড়ির কাজ ও বাইরের কাজ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর উৎপাদন ক্ষমতা পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অক্লান্ত গৃহকর্মের জন্য নারীর কোনো বেতন থাকে না। এমনকি কর্মের কোনো স্বীকৃতিই থাকে না। সবেতন চাকরি করেন না—এমন নারী সম্পর্কে বলা হয় ‘কিছু করে না।’ ষাট শতাংশ সম্পদ এখনও গৃহেই উৎপাদিত হয়। নারীদের এই মূল্যবান শ্রমকে গুরুত্বহীন দেখিয়ে কার্যত নারী সমাজকে হেয় করবারই প্রবণতা প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয়তঃ শ্রমের মতোই প্রজননের ক্ষমতাও নারীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পুরুষশাসিত সমাজে পরিবার পরিকল্পনার নামে কটি সন্তান, কখন কাম্য তা পুরুষই নির্ধারণ করে। এ বিষয়ে নারীর মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই।
তৃতীয়ত : পিতৃতন্ত্র, রাষ্ট্র ও ধর্ম মিলিতভাবে নারীর যৌনতার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখা হয়। তাই কীভাবে তার আকর্ষণ আরও বাড়বে, সেই মতো তার পোষাক, চালচলন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যাইহোক, সামাজিক, পারিবারিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক জীবনকে বিধি নিষেধের মধ্যে রাখা হয়।
(২) ধর্ম ও লিঙ্গরাজনীতিঃ
ধর্ম হল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে লিঙ্গরাজনীতি বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকরী করা হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মে নারীকে অভিশাপ হিসাবে গণ্য করা হয়। ইসলাম এবং ক্যাথলিক ধর্মেও নারীর স্বতন্ত্র মর্যাদা স্বীকার করা হয় না। এইভাবে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ব্যবস্থা নারীজাতির ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে রক্ষা করার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।
(৩) রাজনীতি ক্ষেত্রে লিঙ্গরাজনীতিঃ
লিঙ্গরাজনীতির অন্যতম বহিঃপ্রকাশ মহিলাদের অংশগ্রহণের পুরুষ প্রধান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনীহা লক্ষণীয় ভাবে চোখে পড়ে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় নেই। থাকলেও পুরুষের আড়ালে ঢাকা। ফলে আইন, শাসন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যান্য দিকগুলি সবই পুরুষের ইচ্ছাধীন।
(৪) অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে লিঙ্গরাজনীতি :
অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা লিঙ্গরাজনীতির বহিঃপ্রকাশের অন্যতম নিদর্শন। অধিকাংশ সমাজে সম্পত্তি পুরুষের মালিকানার অন্তর্গত। সম্পত্তি ও আয়ের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে এই বৈষম্য নারীজাতিকে এক শোষিত শ্রেণীতে পরিণত করে। নারী পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সন্তানের জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য যে শ্রমদান করে তার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলিতে নারী ও পুরষকে সমান কাজের জন্য সমান মজুরী দান করা হয় না।
(৫) গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে লিঙ্গরাজনীতি :
লিঙ্গ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গণমাধ্যম। সংবাদপত্র থেকে দূরদর্শন সর্বত্রই পুরুষের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞাপনে এবং চলচ্চিত্রে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হয়।
(৬) জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান ও প্রথার ক্ষেত্রে লিঙ্গরাজনীতি :
তাছাড়া মানব সমাজের জীবনধারণ, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রেও নারীরা অধীনতর স্থানে বিরাজ করে। যে নারী এত ধর্মভীরু, কোনো ধর্মেই তার পৌরোহিত্যের অধিকার নেই। মা কখনও বিবাহের সময় নিজে কন্যাদান করতে পারেন না। সন্তানের অন্নপ্রাশনে মা তার মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেন না। ডাক পরে মাতৃকূলের পুরুষ ভাই-এর। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সমাজে নারী কত হীন সামাজিক অবস্থানে বিরাজ করেন।
মন্তব্যঃ
আমরা পরিশেষে বলতে পারি যে, সাম্প্রতিককালে বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে নারীর এই অধীনতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক সচেতন প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিঙ্গরাজনীতির গুরুত্ব মাত্রা লাভ করেছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .