লঙ্ মার্চ
পরিচিত
মাও-জে-দঙ্ এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে চিনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ-পর্ব চিনের কিয়াং-সি প্রদেশ থেকে উত্তরে শেনসি পর্যন্ত যে দীর্ঘ ৬০০০ মাইল। পদযাত্রা করেছিলেন, চিন তথা বিশ্বের ইতিহাসে তা ‘লঙ্ মার্চ’ নামে খ্যাত। ঐতিহাসিক ইমান্যুয়েল সু লঙ্ মাচের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, ক্ষমতার শীর্ষে মাওয়ের উত্থান ও দলের ইতিহাসে এইট ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা
পটভূমি
কিয়াং-সি ও তার নিকটবর্তী এলাকায় কমিউনিস্টরা প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে উঠলে প্রজাতন্ত্রী চিনের কমিউনিস্ট বিরোধী রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই শেখ আতঙ্কিত হয়ে তাদের দমন করার জন্য সেনা পাঠান (১৯৩৪ খ্রি.)। এদিকে ওই সময় জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে উত্তর চিনের জোহাল পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। কিন্তু চিয়াং জাপানের এই আগ্রাসনের কোনো প্রতিকার না করে কমিউনিস্ট নিধনে অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই পদযাত্রাকারী কমিউনিস্টগণ তাদের পরিবার পরিজনসহ কিয়াং সি ত্যাগ করে উত্তর চিনে পীত নদীর বাঁকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শেনসি প্রদেশ অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন।
পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীগণ
মাও-জে-দঙ্ এবং চুতের মিলিত প্রচেষ্টায় কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করে শুরু হয় লক্ষ মার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রা। লঙ্ মার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রায় প্রায় এক লক্ষ চিনবাসী অংশগ্রহণ করেন। পযদাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৫ হাজার জন ছিলেন সেনা (যারা এই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন) এবং ১৫ হাজার জন্য ছিলেন সরকারি ও কমিউনিস্ট দলের কর্মী। এদের মধ্যে ৩৫ জন ছিলেন মহিলা।
পদযাত্রার বর্ণনা
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর কিয়াং সি প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া ওই পদযাত্রা শেষ হয় পরের বছর ২০ অক্টোবর। দীর্ঘ ওই ৩৭০ দিনের প্রবল দুঃখ দুর্দশার মধ্যে ১৮ টি গিরিশ্রেণি, ২৪ নদনদী অতিক্রম করে যখন তারা শেনসি প্রদেশের ইয়েনানে এসে পৌঁছোন ততদিনে এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯২ হাজারই মৃত্যুবরণ করেছেন। ছ-হাজার মাইলের ওই দীর্ঘ পথে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে করতে তারা কোয়া টুং, হুনান, কোয়াং সি, কোয়োইচো, য়ুনান, সিকাং, জেকুরান, কানসু, শেনসি প্রভৃতি ১১টি চিনা প্রদেশ অতিক্রম করেন।
‘লঙ্ মার্চ’ এর গুরুত্ব
1. অভিজ্ঞতায়
দীর্ঘ পদযাত্রায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের কাছে নতুন করে ধরা দেয় তাদের দেশ, দেশের মানুষ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী। ভবিষ্যৎ দেশগঠনের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা তাদের দারুণভাবে সাহায্য করে।
2. কষ্টসহিষ্ণুতায়
দীর্ঘ পদযাত্রার ওই অসহ্য পরিশ্রম চিনা কমিউনিস্টদের কষ্টসহিম্বুতা ও নিয়মানুবর্তিতা সম্বন্ধে নতুন করে শিক্ষা দেয়। যা পরে কুয়োমিনটাং বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের শক্তি জুগিয়েছিল।
3. অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানসিকতা গঠনে
যে কোনো প্রতিরোধ বা বাধাকে তুচ্ছ করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় দৃঢ় মানসিকতার সাহায্যে, তার উজ্জ্বল নিদর্শন এই পদযাত্রা। চিনের মাটিতে লালফৌজ যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী একথা প্রমাণিত।
4. সহানুভূতি লাভে
দীর্ঘ ওই পদযাত্রায় কমিউনিস্টরা সাধারণ মানুষের কাছে আন্তরিকভাবেই সহানুভূতি সাহায্য লাভ করে। যা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
5. দক্ষতা ও আস্থা অর্জনে
লঙ্ মার্চ এর ওই বিশাল সাফল্যের শেষে চিনা কমিউনিস্টরা যে কোনো সংকটকে অতিক্রম করার মতো দক্ষতা ও আস্থা অর্জন করেছিল।
এডগার স্নোর মতে— লঙ্ মার্চ শুধুমাত্র নিরাপদ স্থানে পৌঁছোনোর প্রচেষ্টা ছিল না, তা ছিল একসঙ্গে দেশ, দেশবাসী এবং আরও অনেক কিছুকে নতুনভাবে আবিষ্কারের অভিযান।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .