মেটারনিখ ব্যবস্থা
১৮১৫-৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ধরে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ ছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রা। তিনি ছিনে প্রতিবিপ্লবের মূর্ত প্রতীক। ইউরোপের সর্বত্র স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল মেটারনিখের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর ওই উদ্দেশ্যকে সফল করতে প্রগতিবিরোধী ও ঘোর রক্ষণশীল যে ভারসাম্য নীতি তিনি গ্রহণ করেন সেটাই ইউরোপের ইতিহাসে মেটারনিখ-ব্যবস্থা বা মেটারনিখতন্ত্র বা মেটারনিখ পদ্ধতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ফিসার, ১৮১৫ খ্রি. ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তী তিরিশ বছর ইউরোপের ইতিহাসকে ‘মেটারনিখের যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
মেটারনিখ-ব্যবস্থার রূপায়ণ বা প্রয়োগ
মেটারনিখ স্বয়ং মেটারনিখ ব্যবস্থার রূপায়ণে যেসব ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন, সেগুলি হল-
(১) ইউরোপে প্রাক্-বিপ্লব রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার লক্ষ্যে তিনি নেপোলিয়ন কর্তৃক যে সমস্ত রাজা সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলেন তাঁদের বংশধরকে স্ব স্ব রাজ্যের সিংহাসনে পুনরাভিষিক্ত করেন। যাতে ভিয়েনা চুক্তি সংরক্ষণ করা যায়।
(২) জার্মানির জাতীয় আন্দোলনকে দমন করতে তিনি কুখ্যাত কার্লম্বাড ডিক্রি জারি করেন। এর দ্বারা তিনি জার্মানিতে সভাসমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। ইতালির ঐক্য আন্দোলনেরও তিনি বিরোধিতা করেন।
(৩) ইউরোপীয় সভ্যতার পীঠস্থান গ্রিস যখন স্বাধীনতার জন্য তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল এবং এথেন্স যখন পতনের মুখে তখনও তিনি গ্রিসের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। মেটারনিখের বৈদেশিক নীতির মূলকথা ছিল, ইউরোপীয় রাজনীতিতে যেভাবেই হোক অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের প্রাধান্য ও প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখা।
মেটারনিখ ব্যবস্থা ব্যর্থতার কারণ
মেটারনিখ-ব্যবস্থা বেশ কিছু কারণে শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়—
(১) জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার
ফরাসি বিপ্লব দমিত হয়েছিল, নেপোলিয়নের পতন হয়েছিল; কিন্তু বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী যে ইউরোপের মানুষের মনে সদাজাগ্রত রয়েছে তা মেটারনিখ স্বীকার করতে চাননি মেটারনিখতন্ত্র জাতীয়তাবাদের জোয়ারে আঘাত হানলেও তাকে একবারে স্তব্ধ করে নিতে পারেনি। এইভাবে ১৮৩০ খ্রি. (জুলাই বিপ্লব)-এর গণ আন্দোলন এবং শেষপর্যন্ত ভিয়েনা থেকে মেটারনিখের লন্ডনে পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গড়ে তোলা ‘ব্যবস্থা’রও পতন ঘটে।
(২) আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন
ইউরোপের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনও মেটারনিখ-তন্ত্রের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। শিল্পবিপ্লব কৃষিনির্ভর ইউরোপীয় অর্থনীতিকে সরিয়ে দিয়ে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটায়। বিশেষ করে ১৮৩০-এর পর থেকে এই পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি সর্বত্র উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। ফলে মেটারনিখের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা পরিবর্তনের উত্তাল ঢেউ-এ তলিয়ে যায়।
(৩) দূরদর্শিতার অভাব
কূটনীতিক হওয়া সত্ত্বেও মেটারনিখের দৃষ্টিভঙ্গিতে দূরদর্শিতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর নীতি ছিল পীড়নমূলক, সুবিধাবাদী, অনৈতিক, নেতিবাচক ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাঁর মধ্যে সংগঠনী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি ফরাসি বিপ্লবের বিধ্বংসী রূপ প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন— “বিপ্লব দুষ্ট ক্ষত, আগ্নেয়গিরি ও বহুমুখ বিশিষ্ট দৈত্যের সঙ্গে তুলনীয়।” গঠনমূলক ভাবধারার অসীম সম্ভাবনাও যে বিপ্লবের মধ্যে থাকতে পারে, তা তিনি খুঁজে দেখেননি। তাই রক্ষণশীলতা দ্বারা জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী উত্থানকে রোধ করতে চেয়ে তিনি ইতিহাসের গতিরই বিরুদ্ধাচরণ করেন। এই কারণেই ঐতিহাসিক কেটেলবি মেটারনিখতন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতির কোনো ছাপ খুঁজে পাননি।
(৪) যুগোপযোগী নয়
যুগের দাবিকে অস্বীকার করার জন্যই মেটারনিখ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল বলা যায়। মেটারনিখ নিজেই বলেছেন— এই পৃথিবীতে আমি হয় খুব আগে, নয়তো খুব দেরিতে এসেছি। আসলে পরিবর্তন যে ইতিহাসের ধর্ম, মেটারনিখের রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাচেতনায় তা ধরা পড়েনি। তাই ঘড়ির কাঁটাকে পিছিয়ে দিয়ে তিনি সময়ের গতিকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। সে সময় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের জাগরণ ছিল অবশ্যম্ভাবী। সে সময় এগুলির বিরুদ্ধাচরণ করা ছিল যুগ পরিপন্থী কাজ। ঐতিহাসিক এলিসন ফিলিপস বলেছেন—যখন পৃথিবী তার নবযৌবন ফিরে পাচ্ছিল তখন তিনি (মেটারনিখ) বার্ধক্যপীড়িত ও অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেখানেই মেটারনিখতন্ত্রের অসারতা।
(৫) সংস্কারবিমুখতা
মেটারনিখ ছিলেন স্থিতাবস্থার এক চরম সমর্থক। মেটারনির্খের সংস্কারবিমুখ মানসিকতার জন্য মেটারনিখ-ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে যায়। নেপোলিয়ন ইতালীয়দের জন্য মেধাভিত্তিক জীবিকা নীতি প্রয়োগ করে যেখানে মেধবীদের কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন, সেখানে মেটারনিখ যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজের সুযোগের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেন। যুগোপযোগী ইতিবাচক মনোভাবের অভাব তাঁর গৃহীত সংস্কার কর্মসূচিগুলি শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়।
(৬) মৌলিক অধিকারে অবিশ্বাস
নাগরিকদের অধিকার,সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলিতে মেটারনিখের বিশ্বাস ছিল না। অথচ ইউরোপবাসীর মনে এই সময় অধিকারগুলি গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তাই তারা মেটারনিখ-ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি জার্মানিতে কার্লম্বাড ডিক্রি জারি করে বিশ্ববিদালয়গুলির ইউনিয়নের অধিকার নিষিদ্ধ করেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .