মৃত্তিকা দূষণ
বিভিন্নভাবে কোনো স্থানের মাটি দূষিত হতে পারে, যেমন :
■ [১] জমিতে বেশি সার ব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাব
চাষের জমিতে নানারকম সার ব্যবহার করা হয়। এই সার দু’ধরনের হয়, যেমন: জৈব সার এবং অজৈব সার। জৈব সারগুলি পচনশীল (biodegradable) হওয়ায়, সহজে প্রকৃতিতে মিশে যায় এবং অল্পসময়ের মধ্যেই বিনষ্ট হয়।
কিন্তু অজৈব সারগুলি পচনশীল নয় এবং বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হলে নানান ধরনের দূষণ সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন :
(১) অতিরিক্ত সার ব্যবহারে মাটির স্বাভাবিক জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। মাটিতে বসবাসকারী জীবাণুদের ক্ষতি হয়। এর ফলে মাটিতে দূষণ দেখা দেয়।
(২) মাটিতে যে উপাদানটির প্রয়োজন নেই সার হিসেবে সেটি প্রয়োগ করলে লাভের পরিবর্তে ক্ষতি বেশি হয় অর্থাৎ ফলন বাড়ার বদলে কমে যায়।
(৩) রাসায়নিক সারের প্রয়োগবিধির বিষয়ে অজ্ঞতার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভুল প্রয়োগের ফলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
(৪) আবার জমির অতিরিক্ত সার জলাশয়ে পড়লে জলজ শেওলারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। পরে সেগুলি পচে গিয়ে জলাশয়ের তলায় জমা হয়ে জলাশয়কে অতি দ্রুত মজিয়ে দেয়।
(৫) অতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগে শুধু মাটিই নয় সামগ্রিক পরিবেশেও দূষণ সৃষ্টি হয়।
■ [২] জমিতে বেশি কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাব
অনেক সময় জমির ফসল এবং গুদামের সঞ্চিত খাদ্যশস্য নানান ক্ষতিকারক প্রাণীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক রকম কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। যেহেতু এই পদার্থগুলি বিষাক্ত, তাই এরা পেস্টের ক্ষতি করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এবং অন্যান্য উপকারী প্রাণী ও উদ্ভিদেরও অনেক ক্ষতি করে।
বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করার ফলে উল্লেখযোগ্য যেসব ক্ষতি হয়, তা হল :
(১) টক্সাকিন, ডি. ডি. টি, বি. এইচ. সি ইত্যাদি কীটনাশকের প্রয়োগে ফসলের শত্রু পোকাদের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু পোকারাও মারা পড়ে। এতে শস্যের ক্ষতি হয়।
(২) জমিতে অত্যধিক সার প্রয়োগ করা ও কীটনাশকের রাসায়নিক পদার্থ মাটি থেকে বাহিত হয়ে জলাশয়ে মিশে জল দূষণ ঘটায় এবং জলজ প্রাণীদের দেহে বিষের মাত্রা বাড়ায়।
(৩) বিষাক্ত রাসায়নিক হাঁস-মুরগির দেহে প্রবেশ করলে ডিমে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়।
(8) অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের শরীরে ধীরে ধীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। ফলে আর কীটনাশকে তেমন সুফল পাওয়া যায় না অর্থাৎ শত্রু পোকাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
(৫) কীটনাশকের কুফল মানুষের শরীরের উপরও পড়ে। শাক-সব্জি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের শরীরে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক জমা হলে স্নায়ু দুর্বল হয়। এর ফলে ফুসফুস ও পাকস্থলির অসুখ এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
এইসব কারণে বিভিন্ন উন্নত দেশগুলিতে ডি.ডি.টি, গ্যামাকসিন ইত্যাদি কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অন্যান্য আরও কয়েক রকমের কীটনাশক ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
■ [৩] জমিতে বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব
গৃহ এবং বাজারের বর্জ্য পদার্থগুলির মধ্যে সারাদিনের তরিতরকারীর খোসা, শাক-সবজি, ব্যবহৃত কাগজ, পলিথিনের প্যাকেট, কাচের টুকরো, শিশি-বোতল, ডাবের খোলা, ধাতব পদার্থের টুকরো, মলমূত্র, ময়লা জল প্রভৃতি প্রধান। এইসব জমানো জঞ্জালের একটা অংশ সবসময়ই রাস্তার পাশে, ডাস্টবিনে বা যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে মূলত দুটি কারণে, যেমন : (ক) জমা জঞ্জাল পুরোপুরি অপসারিত না হওয়া এবং (খ) অপসারিত হবার ঠিক পরেই নতুন আবর্জনা ঐ সব স্থানে ফেলার ফলে। ওইসব জমা আবর্জনা পচনের ফলে ক্ষতিকারক জৈব বা অজৈব রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন হয়ে মাটিকে দুর্গন্ধময় করে তোলে।
এছাড়া ডাস্টবিন ও ভ্যাটে রাখা জঞ্জালের পচনে সৃষ্ট দুর্গন্ধ আশপাশের এলাকায় অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে। ঐ দুর্গন্ধযুক্ত বায়ুর শ্বাসগ্রহণে আমাদের যে কেবলমাত্র বিরক্তি বোধ হয় তাই নয়, অনেকক্ষেত্রে আমাদের শারীরিক ক্ষতিও করে। এছাড়া পচনজাত দ্রব্যগুলি থেকে জীবাণুবাহক মশা, মাছি প্রভৃতি মানুষ ও প্রাণীর শরীরে নানারকমের রোগ ছড়ায়। এটি মৃত্তিকা দূষণের অন্যতম কারণ।
■ [৪] মৃত্তিকা দূষণে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব
আধুনিক সভ্যতার একটি ক্ষতিকারক বর্জ্য পদার্থ হলো প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক জাতীয় কৃত্রিম জৈব যৌগ। এরা পচনশীল নয় এবং সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মানুষ মালপত্র বহন করার জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করেন।
এছাড়াও প্লাস্টিকের বালতি, নানাধরনের খেলনার জিনিস আমরা ঘরে ব্যবহার করি। আবার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়লে এগুলিকে আমরা বর্জ্য পদার্থ হিসেবে এখানে-সেখানে ফেলে দিই। এই বর্জ্য পদার্থগুলি ক্রমে জমি, নালা, নর্দমা, খাল, নদী ইত্যাদি ভরাট করতে থাকে। ফলে মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং রাস্তাঘাট জলে ডুবে যায়। এছাড়া জলাজমিগুলি বুজে যায়। এক কথায় প্লাস্টিক পরিবেশে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে।
■ [৫] মাটি দূষণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব
(ক) শিল্পকেন্দ্রগুলিই পরিবেশ দূষণের মূল উৎস। শিল্পে ব্যবহৃত জলের সঙ্গে নানারকম দূষিত বর্জ্য পদার্থ নির্গত হয়। শিল্পজাত বর্জ্য পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার তেল জাতীয় পদার্থ, প্লাস্টিক, ধাতব দ্রব্য, বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক দ্রব্য এবং অদ্রাব্য ভাসমান বস্তু প্রধান। জৈব পদার্থ ব্যবহারকারী শিল্পগুলি বেশি মাত্রায় মৃত্তিকা দূষণ ঘটায়। এই শিল্পগুলি হল চমশিল্প, তৈল শোধনাগার, পানীয় প্রস্তুতকারী শিল্প, কাপড়, কাগজ, রবার প্রভৃতি শিল্প।
(খ) এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা থেকে গ্যাসীয় এবং অগ্যাসীয় দূষক পদার্থ নির্গত হয়ে মৃত্তিকাতে মিশে পরিবেশকে দূষিত করে। যেমন : তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত উড়ন্ত ছাই মাটিতে মিশে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা শক্তিকে নষ্ট করে দেয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .