মুসোলিনীর বৈদেশিক নীতি
ভূমিকা
মুসোলিনীর পররাষ্ট্র নীতির মূল কথাই হল সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালীর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, আন্তর্জাতিক শান্তি হল কাপুরুষের স্বপ্ন— সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধনীতি হল জাতির প্রাণশক্তির প্রাচুর্যের প্রমাণ। এই কারণে তিনি ইতালীর জল স্থল ও বিমানবাহিনীকে অত্যাধুনিকভাবে পুনর্গঠিত করে তিনটি বাহিনীরই অধ্যক্ষ-পদ গ্রহণ করেন।
ফ্রান্স বিরোধিতা
সূচনাপর্বে মুসোলিনীর বৈদেশিক নীতি ফ্রান্স ও যুগোশ্লাভিয়া বিরোধী ছিল। মুসোলিনীর ফরাসী বিরোধিতার বেশ কিছু কারণ ছিল। (১) ইতালী অনেক আশা নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কিন্তু যুদ্ধান্তে প্যারিস শাস্তি সম্মেলনে ইতালীই ছিল সর্বাপেক্ষা বঞ্চিত রাষ্ট্র। মূলত ফ্রান্সের আপত্তিতেই ইতালী বেশ কিছু স্থান, যেমন—টিউনিশিয়া, কর্সিকা, স্যাভয়, নীস প্রভৃতি স্থান লাভে বঞ্চিত হয়। এর ফলে ইতালী ফ্রান্সের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
(২) এছাড়া, যুদ্ধের সময় ফ্রান্সের বহু লোকক্ষয় হয়। এ কারণে ফরাসী সরকার পার্শ্ববর্তী দেশগুলির নাগরিকদের স্থায়িভাবে ফ্রান্সে বসবাসের আহ্বান জানায়। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বহু ফ্যাসি-বিরোধী ইতালীয় ফ্রান্সে বাস করতে শুরু করে, যা মুসোলিনীকে ক্ষুব্ধ করে।
(৩) ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে ইতালীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফ্রান্স। এইসব কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর-পর্বে ইতালী ও ফ্রান্সের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।
অন্যান্য রাষ্ট্র
ইতালী যুগোশ্লাভিয়ার ডালমাশিয়া ও ফিউম অঞ্চলের ওপর দাবি জানালে যুগোশ্লাভিয়া তার অনেকগুলি দাবি মেনে নেয় (১৯২৪ খ্রিঃ)। কয়েকজন ইতালীয়কে হত্যার অভিযোগে ইতালী গ্রীসের করফু দ্বীপটি দখল করে। শেষ পর্যন্ত লীগের হস্তক্ষেপে গ্রীস ক্ষতিপূরণ দানে স্বীকৃত হলে ইতালী করফু থেকে সেনা অপসারণ করে।
আবিসিনিয়া আক্রমণ— কারণ
এরপর মুসোলিনীর দৃষ্টি পড়ে পূর্ব আফ্রিকার আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) রাজ্যটির ওপর। ইতালীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য স্থান সংকুলান ও প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান এবং শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ আবিসিনিয়ার ওপর দীর্ঘদিন ধরেই ইতালীর শোনদৃষ্টি ছিল। ইতিপূর্বে ইতালী লিবিয়া, ইতালীয় সোমালিল্যান্ড ও ইরিত্রিয়া লাভ করেছিল। সোমালিল্যান্ড ও ইরিত্রিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত আবিসিনিয়া দখল করতে পারলেই ইতালীর পূর্ব আফ্রিকা রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা পূর্ণতা পেত।
এছাড়া, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালী আবিসিনিয়া আক্রমণ করে পরাজিত হয়। সুতরাং এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছাও মুসোলিনীকে আবিসিনিয়া আক্রমণে প্রণোদিত করে।
আবিসিনিয়া আক্রমণ
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর আবিসিনিয়া-সোমালিল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত ওয়াল-ওয়াল গ্রামে ইতালীয় ও আবিসিনীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে খণ্ডযুদ্ধে কিছু ইতালীয় সেনার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার অজুহাতে মুসোলিনী আবিসিনিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি-র কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দাবি করেন যদিও এই খণ্ডযুদ্ধের মৃতের সংখ্যায় আবিসিনীয়রাই ছিল বেশি।
আবিসিনিয়া এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘে আবেদন জানায় এবং লীগের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। ইঙ্গ-ফরাসী হস্তক্ষেপে লীগ একটি মীমাংসা কমিটি নিয়োগ করা ব্যতীত অন্য কিছুই করেনি। ইতিমধ্যে ইতালী আবিসিনিয়া সীমান্তে ব্যাপকভাবে সেনাসমাবেশ করে এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা অক্টোবর আবিসিনিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লীগের মীমাংসা কমিটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। জাতিসঙ্ঘ ইতালীকে ‘আক্রমণকারী’ বলে ঘোষণা করে এবং তার সব সদস্যকে ইতালীর বিরুদ্ধে গৃহীত কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মেনে চলার নির্দেশ দেয়। এই ব্যবস্থা অনুসারে লীগ তার সব সদস্য-রাষ্ট্রকে ইতালীর সঙ্গে সর্বপ্রকার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ অনুসারে ৫৩টি দেশ ইতালীকে কোন রকম আর্থিক ঋণদান না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ৫০টি দেশ ইতালীর সঙ্গে সব লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জাতিসঙ্ঘের নির্দেশ পালনে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিল না। ব্রিটেন ইতালীকে তেল সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ব্রিটেন তেল সরবরাহ বন্ধ রাখলে ইতালী যুদ্ধ স্থগিত রাখতে বাধ্য হত। ইতালীর চাপের মুখে আবিসিনিয়া ভেঙে পড়ে এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে আবিসিনিয়ার সম্রাট হাইলে স্লোসি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ৯ই মে ইতালীর রাজা আবিসিনিয়ার সম্রাট বলে ঘোষিত হন এবং ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ড ও আবিসিনিয়া নিয়ে ‘ইতালীর পূর্ব আফ্রিকা’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইতালী জাতিসঙ্ঘ পরিত্যাগ করে।
তাৎপর্য
(১) এই ঘটনার দ্বারা লীগের দুর্বলতা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হল–প্রমাণিত হল যে, শক্তিশালী রাষ্ট্র লীগের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য নয়।
(২) লীগের নির্দেশ অমান্য করে ইতালীর আবিসিনিয়া জয় হিটলারকেও ভার্সাই ‘চুক্তি’ ভঙ্গে উৎসাহিত করে।
(৩) আবিসিনিয়ার ঘটনা ইতালীকে ইওরোপীয় রাষ্ট্রজোট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং সে জার্মানীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। এইভাবে ইওরোপে নতুন শক্তিজোটের আবির্ভাব ঘটে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .