মহাদেশীয় অবরোধ
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক কৃতিত্ব অব্যাহত রাখার জন্য ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কার্যকরী করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, যা ‘মহাদেশীয় অবরোধ’ নামে পরিচিত। ১৮০৫ থেকে ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কালে তিনি এই অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করেন।
পটভূমি
‘মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটেন ও তার ঔপনিবেশিক বাণিজ্য। ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের প্রায় সবকটি বৃহৎ শক্তিকে পরাজিত করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। রাশিয়া, প্রাশিয়া, অষ্টিয়ার মত বৃহৎ শক্তিগুলি তার সামরিক প্রাধান্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। নীলনদের যুদ্ধ (১৭৯৮ খ্রীঃ) ও ট্রাফালগারের যুদ্ধে (১৮০৫ খ্রীঃ) ইংল্যাণ্ডের পরাজিত হলে নেপোলিয়নের অপরাজেয় সৈনিকের অহং আহত হয়। তিনি উপলব্ধি করেন যে নৌ-শক্তিধর ইংল্যান্ডকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে তিনি ইংল্যান্ডকে পঙ্গু করে বিধ্বস্ত করতে উদ্যোগী হন। এই উদ্যোগের পরিণতি হল ‘মহাদেশীয় অবরোধ।
অবরোধের মৌল উদ্দেশ্য
ঐতিহাসিক কোবান-এর মতে, মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণার পশ্চাতে নেপোলিয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি—
(১) শিল্পোন্নত দেশ ইংল্যান্ডের অর্থ-সম্পদ ও প্রতিপত্তির প্রধান ভিত্তি ছিল তার উন্নত শিল্পপণ্য ও বিশ্বজোড়া ঔপনিবেশিক বাণিজ্য। নেপোলিয়ন উপলব্ধি করেন যে, ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধ বাণিজ্য বন্ধ করে দিলে তার সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির উৎস শুকিয়ে যাবে।
(২) নেপোলিয়নের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের শিল্পায়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করা। তিনি ভেবেছিলেন যে, ইউরোপের বাজারে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ বন্ধ হলে সেই স্থান দখল করবে ফ্রান্স। অতঃপর ফ্রান্স নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন করে বৃহত্তর বাণিজ্য দ্বারা প্রভূত সম্পদ সঞ্চয় করতে সক্ষম হবে। কোবান এই ব্যবস্থাকে ‘বোনাপার্টিস্ট কোলাবাৰ্টিজম্’ বলেছেন।
মহাদেশীয় অবরোধের সূচনা
কণ্টিমেণ্টাল সিস্টেমের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খ্রীঃ-এর নভেম্বরে তিন বার্লিনের আদেশ জারি করেন। এই ঘোষণায় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অবরোধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ব্রিটেন ও তার উপনিবেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়।
১৮০৭ খ্রীঃ-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ‘পরিষদীয় আদেশ বত্রা Order in Council-এর দ্বারা ইংল্যান্ড বার্লিন ডিক্রীর জবাব দেয়। ফ্রান্স ও তার মিত্রদেশগুলিতে ইংল্যাণ্ডের নৌ-অবরোধ ঘোষিত হয়। এই সকল দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য সকল নিরেপক্ষ দেশকেও ব্রিটেনের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তাদের জাহাজের পণ্যের জন্য যে-কোন ব্রিটিশ বন্দরে শুল্ক দিতে বলা হয় ঘোষণা করা হল এই নির্দেশ অমান্য করলে পণ্যবহনকারী জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর প্রতুত্তরে এবং বার্লিন ডিক্রীর পরিপূরক হিসেবে ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে নেপোলিয়ন ‘মিলান ডিক্রী’ জারি করেন। এতে বলা হয়, শত্রু মিত্র অথবা নিরপেক্ষ যে-কোন দেশের জাহাজ যদি ব্রিটিশ আদেশ মেনে নেয়, তবে সেই জাহাজ ইউরোপীয় বন্দরে যা মুক্ত সমুদ্রে ব্রিটিশ সম্পত্তি হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা হবে। এবং কোন দেশের জাহাজকে ব্রিটেন বা তার উপনিবেশের বন্দরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করা হল। এরপর মিলান ডিক্রীর অংশ হিসেবেই ওয়ারস ডিক্রী ও ফন্টেন ব্লু ডিক্রী জারি করা হয়। এতে বলা হয় আদেশভঙ্গের অপরাধে যে সকল ইংরেজ মাল ধৃত হবে, তা প্রকাশ্যে আগুনে পোনানো হবে। বার্লিন ডিক্রী, মিলান ডিক্রী, ওয়ারন ডিক্রী ও ফন্টেন ব্লু-ডিক্রী একযোগে ‘কণ্টিনেন্টাল সিস্টেম’ নামে পরিচিত।
ইংল্যান্ডের ক্ষতি
মহাদেশীয় ব্যবস্থা ব্রিটেনের পক্ষে একেবারে ক্ষতিকর হয়নি তা বলা চলে না। ইংল্যান্ডে প্রস্তুত পণ্যের এক-তৃতীয়াংশ ও উপনিবেশ থেকে আনা পণ্যের তিন-চতুর্থাংশ ইউরোপে রপ্তানি করা হত। সুতরাং ইউরোপের সাথে বাণিজ্য নিষিদ্ধ হলে ব্রিটিনের অর্থনৈতিক জীবনে সংকট দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। তাই ১৮০৭ সালে ইংল্যান্ড জোর করে বাল্টিক বাজার ঢুকে কোপেনহেগেনে গোলাবর্ষণ করে। উপরন্তু নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ বাজেয়াপ্ত করাতে ১৮১২ সালে আমেরিকার সাথে তার যুদ্ধ লাগে। ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের সাথে বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার ১৮০৮ খ্রীঃ এ ইংল্যাণ্ড ইউরোপীয় ভূখণ্ডের সাথে বাণিজ্যরত জাহাজকে দরাজ হাতে লাইসেন্স দিতে থাকে। ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দের বসন্তকাল থেকে ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কণ্টিনেণ্টাল সিস্টেমের কঠোরতা ইংল্যাণ্ডের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক মুহূর্ত আসে যখন ১৮১১ খ্রীঃ-তে ব্রিটেন প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকট-কবলিত হয়। এই বছরে অজন্মার ফলে ব্রিটেনে বেকারের সংখ্যাবৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি-হ্রাস, লাভগোষ্ঠীর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়।
মহাদেশীয় অবরোধের ব্যর্থতার কারণ
দুটি কারণে মহাদেশীয় অবরোধ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। তত্ত্বগতভাবে সামুদ্রিক অবরোধের পরিকল্পনা সঠিক ছিল। এই ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভরশীল ছিল দু’টি বিষয়ের উপর, যথা—
(১) বিশাল নৌ-বহর এবং (২) উন্নত শিল্পোৎপাদন। দু’টি ক্ষেত্রেই ফ্রান্স ইংল্যাণ্ডের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। (১) স্বল্পসংখ্যক জাহাজ নিয়ে ফ্রান্সের পক্ষে সমগ্র ইউরোপীয় উপকূল পাহারা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে চোরাপথে ইংল্যান্ডের মাল ইউরোপে আমদানি হতে থাকে। নেপোলিয়নের পক্ষে তা বন্ধ করা সম্ভবপর ছিল না। (২) ইংল্যাণ্ডের কলকারখানায় তৈরি মালের ইউরোপে দারুণ চাহিদা ছিল। শিল্পে অনগ্রসর ফ্রান্সের মাল দ্বারা এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া, তখনো ইংল্যাণ্ডই ছিল বিশ্ব-বাণিজ্যের দরজা। সুতরাং ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার অর্থ নিজেদের ব্যবসা বন্ধ করে আর্থিক ক্ষতি করা। এজন্য মহাদেশীয় অবরোধ-প্রথা জনপ্রিয়তা হারায়। বিভিন্ন দেশ গোপনে ইংল্যাণ্ডের দ্রব্যাদি ক্রয় করতে বাধ্য হয়। সমুদ্রপথে নিরপেক্ষ দেশগুলির জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ব্রিটিশ জাহাজগুলিই আগ্রহী দেশগুলিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ব্রিটিশ জাহাজগুলিই আগ্রহী দেশগুলিতে মাল পরিবহণ করতে থাকে। পরিণতিতে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক বাণিজ্যে নতুন জোয়ার আসে। (৩) নিরপেক্ষ দেশের ইংল্যাণ্ডের মাল আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারে নেপোলিয়নের দাবি অস্বীকার করলে তিনি পোপকে বন্দী করেন এবং পোপের ক্ষোভ সমগ্র ইউরোপের ক্ষোভে পরিণত হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .