ভূমিকম্প
ভূ-অভ্যন্তরে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া কোনো কম্পনের জন্য ভূত্বকের কিছু অংশ যখন ক্ষণিকের জন্য প্রবল অথবা মৃদুভাবে কেঁপে ওঠে তখন তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূপৃষ্ঠের এই কম্পন মৃদু হলে অনেক সময় বোঝা না গেলেও, ভূপৃষ্ঠের কম্পন যখন প্রবল হয়। তখন তা ধ্বংস ও মৃত্যু ডেকে আনে।
ভূমিকম্পের কারণ
ভূমিকম্প প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম এই দু’ভাবেই হতে পারে।
[ক] ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ
[১] ভূ-ত্বকের সঞ্চরণশীল পাত পরস্পরের কাছে সরে আসার জন্য ভূমিকম্প
ভূ-ত্বক কয়েকটি ‘গতিশীল প্লেট’বা পাতের সমন্বয়ে তৈরি, যাদের এক-একটি কেবল মহাসাগর বা মহাদেশ (বা দেশ) অথবা দুইই মিলিয়ে গঠিত হতে পারে, যেমন: ইউরেশিয়ান প্লেট, আফ্রিকান প্লেট, প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট, বর্মা প্লেট, ভারতীয় প্লেট প্রভৃতি। এই সব গতিশীল পাতগুলোর মধ্যে যে কোন দুটি পাত যখন পরস্পরের কাছে সরে আসে, তখন ঐ দুটি পাতের সংযোগরেখা বরাবর শিলাচ্যুতি ঘটে এবং ভূমিকম্প হয়। পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলো (যেমন : প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প বলয়, ইউরেশিয় ভূমিকম্প বলয়, ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প বলয়) এই সব গতিশীল পাতের সংযোগস্থল বরাবর অবস্থিত হওয়ার জন্যই ভূমিকম্পপ্রবণ হয়েছে।
• উদাহরণ
২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার) তারিখে ইন্দোনেশিয়ার সব থেকে বড়ো দ্বীপ সুমাত্রার ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কেন্দ্রীভূত হওয়া ভূমিকম্পটি স্থানীয় সময় সকাল ৭টা নাগাদ প্রথম অনুভূত হয়, রিক্টার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৯। এর পর ধারাবাহিকভাবে ৬টি জোরালো থেকে মাঝারি ভূ-কম্পন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সমুদ্রতলের ৪০ কিমি গভীরে, যার দরুন প্রতিটি কম্পনের সঙ্গে ভারত মহাসাগরের উত্তর উপকূল জুড়ে প্রবল থেকে প্রবলতর সামুদ্রিক জলোচ্ছাস বা সুনামির সৃষ্টি হয়। সুমাত্রার নীচে অবস্থিত ভারতীয় পাতটি বিপজ্জনকভাবে বর্মা পাতের নীচে চাপা পড়ে যাওয়াই ছিল এই ভূমিকম্পের প্রধান কারণ।
[২] ভূত্বকের সঞ্চরণশীল পাতগুলোর পারস্পরিক থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য ভূমিকম্প
ভূত্বকের গতিশীল পাতগুলো যখন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যায় তখন চাপের তারতম্যের ফলেও ভূমিকম্প হয়।
[৩] নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি
নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে দুটি পাত সীমার সংযোগস্থল বরাবর ভূপৃষ্ঠের গঠন অসম্পূর্ণ থাকার কারণে ভূ-ত্বক সুস্থির না হওয়ায় কোমল শিলায় ভাঁজ পড়ার সময় ভূমিকম্প হয়। এই কারণে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ।
[৪] আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে ভূমিকম্প
অগ্ন্যুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে প্রবল বেগে উত্তপ্ত লাভা নিঃসরণের ফলে ভূ-গর্ভস্থ লাভা-আধারে যে ক্রমাগত সঙ্কোচন ঘটে, তাতেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া
[৫] অন্যান্য কারণ
(১) বৃষ্টিপাতের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে ধস নামলে, (২) ভূ-পৃষ্ঠের চাপের বৈষম্যের জন্য, (৩) ভূগর্ভের তাপ বিকিরণের ফলে, (8) ভূ-গর্ভে বাষ্পরাশির চাপের ফলে এবং ক্রমাগত চাপের ফলে ভূপৃষ্ঠের কোন অংশের শিলাস্তর ভেঙে গিয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
[খ] ভূমিকম্পের কৃত্রিম কারণ –
[১] পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ
অধুনা বিভিন্ন দেশে ভূ-গর্ভে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধান করা হয়। এই ধরনের বিস্ফোরণের ফলে আশপাশের ভূপৃষ্ঠে প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের মতো প্রবল ভূকম্পন অনুভূত হয়।
[২] নদীতে বাঁধের ফলে সৃষ্ট ভূমিকম্প
জনৈক রুশ বৈজ্ঞানিকের মতে কোনো স্থানে নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার সৃষ্টি করলে বিশাল জলরাশির চাপে ভূক্তরে ফাটল ধরে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৬৭ সালে মহারাষ্ট্রের কয়নানগরে কয়না বাঁধের জলাধারের প্রবল চাপে এই ধরনের ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়েছিল।
[৩] নবীন পার্বত্য অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরের মধ্যে স্খলনের ফলে সৃষ্ট ভূমিকম্প
নবীন পার্বত্য অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরের মধ্যে স্খলনের ফলে ভূমিকম্প হয়। এই কারণে পৃথিবীর ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলগুলো প্রধানত নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত থাকতে দেখা যায়। হিমালয় পর্বতের শিলাস্তরের চ্যুতির ফলে ১৯৩৪ সালে বিহার রাজ্যের দ্বারভাঙা ও মুঙ্গের অঞ্চলে এবং ১৯৫০ সালে অসম উপত্যকায় ভূমিকম্প হয়।
[৪] ভূগর্ভের তাপজনিত কারণে ভূমিকম্প
ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা তাপজনিত চাপ কোনো কারণে হ্রাসপ্রাপ্ত হলে ভূত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ভূমিকম্পের ফলাফল
(১) সমুদ্রতলে ভূমিকম্পের ফলে সুনামি সৃষ্টি
সমুদ্রতলে ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রে জলস্ফীতি ঘটে উপকূলভাগে সুনামির তাণ্ডব দেখা দিতে পারে [২০০৪ সালে সুমাত্রাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত (আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ) শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপে ভয়াবহ সুনামি বা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় ও বহু সম্পত্তি হানি ঘটে। রিক্টার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৯।];
(২) ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রতলের কিছু অঞ্চল উঠে যায় বা নীচে বসে যায়
২০০৪ সালের সামুদ্রিক ভূমিকম্পের ফলে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা উপকূলের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি দ্বীপ প্রায় ২০ মিটার সরে গিয়েছে এবং সমুদ্রতলে সুমাত্রা থেকে আন্দামান পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে);
(৩) ভূমিরূপের পরিবর্তন
২০০৪ সালের সামুদ্রিক ভূমিকম্পের ফলে ভারতের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের স্থলভাগের স্থানে জলভাগ এবং জলভাগের স্থানে স্থলভাগের সৃষ্টি হয়েছে, এর ফলে এই অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক মানচিত্রে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে;
(৪) ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রোপকূলবর্তী ভূমি উপরে উঠে যেতে বা বসে যেতে পারে
১৮৯৯ সালের ভূমিকম্পের ফলে উত্তর আমেরিকার আলাস্কা উপকূলের কিছু অংশ প্রায় ১৮ মিটার উঠে গিয়েছিল,
(৫) ভূমিকম্পের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বসে গিয়ে জলাভূমি সৃষ্টি হতে পারে
১৯১৯ সালের ভূমিকম্পের ফলে গুজরাট রাজ্যের কচ্ছের রণ অঞ্চল বসে গিয়ে জলাভূমির সৃষ্টি হয়।
(৬) ভূ-ত্বকে চ্যুতি, ফাটল, উপত্যকা ও গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে ভূ-ত্বকে অনেক চ্যুতি, ফাটল, উপত্যকা এবং গ্রস্ত উপত্যকা সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় বিস্তৃত অঞ্চল বসেও যায় (১৯২০ সালের ভূমিকম্পে চিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বসে গিয়েছিল);
(৭) ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের পাললিক শিলাতে ভাঁজ পড়ে। ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়;
(৮) নদীর গতির পরিবর্তন
ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় নদীর গতির পরিবর্তন হয় (১৯৫০ সালের ১৫ই আগস্টের ভূমিকম্পে অসমের ডিবং নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছিল);
(৯) সমুদ্রে দ্বীপের সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রে দ্বীপের সৃষ্টি হয়;
(১০) ধস ও হিমানী সম্প্রপাতের সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে বিরাট ধস ও হিমানী সম্প্রপাতের সৃষ্টি হয় (১৯৩৪ সালে বিহারের ভূমিকম্পের ফলে দার্জিলিং হিমালয়ে ধস সৃষ্টি হয়);
(১১) সমভূমিতে গর্ত ও ফাটলের সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে সমভূমিতে বিরাট গর্ত ও ফাটলের সৃষ্টি হতে পারে, এই সব ফাটল দিয়ে কাদা, বালি ও গরম জল বের হতে থাকে;
(১২) নদী শুকিয়ে যাওয়া
ভূমিকম্পের ফলে উৎসমুখ অবরুদ্ধ হয়ে নদী শুকিয়ে যেতে পারে;
(১৩) জীবন ও সম্পত্তিহানি
ভূমিকম্পের ফলে জীবন ও সম্পত্তিহানি হয়ে মানুষের দুর্দশার সীমা থাকে না।
Frequently Asked Questions
কোন্ বাঁধের জলধারার প্রবল চাপে ভারতে ১৯৬৭ সালে ভূমিকম্প হয়েছিল?
কয়না বাঁধের জলধারার প্রবল চাপে ভারতে ১৯৬৭ সালে ভূমিকম্প হয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .