ভারতে মিশনারিদের অবদান
ভারতের ইতিহাসে ইউরোপীয় মিশনারিদের প্রবর্তিত শিক্ষায় হল পাশ্চাত্য শিক্ষা। কারণ ইংরেজদের পূর্বে পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি জাতির মিশনারিরা আমাদের দেশে ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সুতরাং, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতার হাত ধরে রাজনৈতিক ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হলেও আধুনিক শিক্ষার অভিষেক ইউরোপীয় মিশনারিদের হাত ধরেই হয়েছিল।
পোর্তুগিজ মিশনারিদের অবদান
পোর্তুগিজ মিশনারিরাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তক। পোর্তুগিজ বণিকদের ব্যাবসাকেন্দ্র— গোয়া, দমন দিউ, কালিকট, হুগলি প্রভৃতি স্থানে সে সময় রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকরা যেমন রবার্ট-দ্য নবিলি, ফ্রান্সিস জেভিয়ার উপস্থিত হয়ে ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আদর্শে কতকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তখন ইউরোপীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় প্রোটেস্টান্ট এবং রোমান ক্যাথলিক এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শোনা যায় যে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্যে জেডিরার নাকি চলার পথে একটা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মানবহৃদয় জয় করার চেষ্টা করতেন।
তা ছাড়া বিদ্যানুরাগী জেভিয়ার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “প্রতিটি গ্রামে একটি করে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, যাতে করে সেখানে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারে।” এই এক বাক্যের জোরে জেডিয়ার ও তাঁর অনুগামীরা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।
যাই হোক নিজ দেশে নিজ ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে মিশনারিরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এ কথা সত্য যে, মিশনারিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল সামাজিক পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে দেশীয় উন্নয়নসাধন এবং স্বধর্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারার দ্বারা সমগ্র মানবসভ্যতার সংস্কার করা। সে সময় পোর্তুগিজ মিশনারিরা মূলত যে চার ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, সেগুলো হল—
[1] মিশন ও গির্জার সঙ্গে যুক্ত বিদ্যালয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল জনগণকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। আর সেখানে দেওয়া হত পোর্তুগিজ ও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা, ধর্ম, সংগীত প্রভৃতি।
[2] ভারতের অনাথ শিশুদের জন্য শিক্ষালয়, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে দেওয়া হত কৃষি বিষয়ক শিক্ষা ও শিল্প শিক্ষা।
[3] উচ্চ শিক্ষার্থে জেসুইট কলেজ সেখানে পড়ানো হত অঙ্কশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, লাতিন প্রভৃতি।
[4] সেমিনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— এগুলিতে দেওয়া হত ধর্ম বিষয়ক শিক্ষা এবং ধর্ম শিক্ষা প্রচারের কৌশল বা পাদরি তৈরির প্রশিক্ষণ।
পোর্তুগিজ মিশনারিদের অন্যতম অবদান হল 1556 খ্রিস্টাব্দে গোয়াতে তাঁদের প্রচেষ্টায় ভারতে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয়। ওই মিশনারিরা আরও 4 টি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। সেখানে ভারতীয় ভাষায় বই ছাপা হত। ফলে ভারতে পোর্তুগিজ শক্তির পতনের সঙ্গে সঙ্গে পোর্তুগিজ মিশনারি শক্তিরও পতন ঘটতে থাকে। কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দেশীয় খ্রিস্টানদের সহযোগিতায় ও বদান্যতায় দীর্ঘদিন কাজ করে গেছে।
ওলন্দাজ মিশনারিদের অবদান
1602 খ্রিস্টাব্দে, অর্থনৈতিক চাহিদা তৃপ্ত করতে ভারতে ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য ওলন্দাজ বা ডাচ, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল। কোম্পানির প্রধান কর্মস্থল ছিল হুগলি নদীর তীরসংলগ্ন চুঁচুড়া; কিন্তু এঁদের বাণিজ্যের প্রভাব বেশিদূর গড়ায়নি, বাস্তবায়িত হয়নি এঁদের প্রয়াস। এঁদের সঙ্গে যে সকল প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান মিশনারিরা এসেছিলেন, তাঁরাও শিক্ষাবিস্তারে ভারতে উল্লেখযোগ্য দান রেখে যেতে পারেননি। তবে কেবল কোম্পানির কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের জন্য কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
ফরাসি মিশনারিদের অবদান
1664 খ্রিস্টাব্দে ভারতে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল। যার কর্মকেন্দ্র ছিল–চন্দননগর, পুদুচেরি, মাছে, ইয়ানাম, কারিকল প্রভৃতি। যেহেতু ফরাসি বণিকেরা ফরাসি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল, সেহেতু এঁদের সঙ্গে যুক্ত মিশনারিরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে শিক্ষাক্ষেত্রে ফরাসি সরকারের নীতি বহুলাংশে গ্রহণ করেছিলেন। মিশনারিরা ফরাসি অধিকৃত অঞ্চলে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ওই সকল বিদ্যালয়ে যথার্থ চেতনার উন্মেষ ঘটাতে দেশীয় শিক্ষক দ্বারা দেশীয় ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অবশ্য কিছু বিদ্যালয়ে দেশীয় ভাষা ছাড়া ফরাসি ভাষাতেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল।
দিনেমার বা ড্যানিশ মিশনারিদের অবদান
দিনেমার বা ড্যানিশ বণিকেরা সপ্তদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর ও ত্রিবাঙ্কুরে এবং বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত দিনেমার মিশনারিদের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল ত্রিবাঙ্কুর এবং শ্রীরামপুর। শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে Zegenbalg (জিগেনবার) এবং Pluischau (গ্লুশো)—এই দুই দিনেমার মিশনারির দান বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এঁরা মিশনারিদের উন্নত জীবনাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে 1713 খ্রিস্টাব্দে একটি তামিল ভাষার ছাপাখানা এবং 1717 খ্রিস্টাব্দে গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি Charity School (অবৈতনিক বিদ্যালয়) স্থাপন করেছিলেন। এ ছাড়াও 1716 খ্রিস্টাব্দে তিনি ত্রিবাঙ্কুরে একটি শিক্ষক-শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
আত্মসচেতনশীল শিক্ষাবিদ Zegenbaig তামিল ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন। Zegenbalg, 1719 খ্রিস্টাব্দে মর্ত্যালোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, Schwartz (স্কোয়াড), Schultz (ন্যুলজ), Kiernander (কায়েনান্ডার) প্রমুখ মিশনারি তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে দিনেমার অঞ্চল-সহ সম্পূর্ণ দক্ষিণ ভারতে তাঁদের কর্মকাণ্ডের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পূর্বসূরি Zegenbalg-এর মতাদর্শ ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা অনুসরণে Schwartz (স্কোয়াজ) তাঞ্জোরে এবং ব্রিটিশপল্লীতে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 1785 খ্রিস্টাব্দে তাঞ্জোর, রামনাথ এবং শিবগঞ্জে তিনটি ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য 1787 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টার্স, Schwartz প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য বার্ষিক 250 প্যাগোডা সাহায্য মঞ্জুর করেছিলেন।
শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে দিনেমার মিশনারি Schultz-এর ভূমিকাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মাদ্রাজে দুটি নতুন বিদ্যালয় এবং একটি চার্চ তৈরি করেছিলেন। তিনি তেলুগু ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন।
বিদ্যানুরাগী দিনেমার মিশনারি Kiernander ও ভারতে সমাজসংস্কারে বিশেষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন। 1742 খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট সেন্ট ডেভিডে তিনি পৃথক পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। পলাশির যুদ্ধের পর 1758 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের আমন্ত্রণে Kiernander বাংলায় আসেন এবং বাংলায় শিক্ষাবিস্তারে ব্রতী হয়ে কতকগুলি Charity School (অবৈতনিক বিদ্যালয়) স্থাপন করেন।
ইংরেজ মিশনারিদের অবদান
1600 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে 15 বছরের জন্য ভারতে বাণিজ্য করার অনুমতি দিলে, অনুমতি সাপেক্ষে কোম্পানির সঙ্গে মিশনারিরাও ভারতে আসেন।মিশনারিরা প্রদেশে ধর্মপ্রচারে এবং শিক্ষাবিস্তারে উৎসাহী হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই উৎসাহে সাড়া দেন। ফলে কোম্পানি যাদ্রাজে ফোর্ট সেন্ট জর্জের কুঠি এলাকায় 1673 খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয় স্থাপন করে। পরে অন্যান্য এলাকায় অনুরূপ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ওই সকল বিদ্যালয়ে শুধু ইউরোপীয় কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল। তবে পরবর্তী পর্যায়ে সমাজজীবনের চাহিদা মেটাতে ভারতীয় কর্মচারীদের সন্তানরাও ওই বিদ্যালয়গুলিতে পড়ার সুযোগ পায়। ফলে এক্ষেত্রে শিক্ষায় সাম্যের অধিকার বহুলাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সনদ নবীকরণ, 1698 এর সময় যে শর্তগুলি কোম্পানির ওপর আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলি হল—
[1] ভারতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত সকল কারখানায় Minister of Religion (ধর্মমন্ত্রী) নিয়োগ করতে হবে।
[2] ধর্মমন্ত্রীদের ভারতীয় ভাষা জানতে হবে।
[3] 500 টন বা তার অধিক পণ্যবাহী প্রত্যেকটিতে জাহাজে কমপক্ষে একজন খ্রিস্টান পাদরি থাকবেন।
[4] প্রয়োজন অনুযায়ী, কোম্পানিকে প্রতিটি কারখানায় এবং সেনানিবাসে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
[5] শিক্ষা দানের দায়িত্বে থাকবেন মিশনারিরা বা পাদরিরা।
সনদের শর্তগুলো ইংরেজ মিশনারিদের মনোজগতের ভিত দৃঢ় করে। আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করে, ভারতে ধর্মপ্রচারে এবং শিক্ষার সম্প্রসারণে সহায়তা করে। সনদের শর্তাবলি কোম্পানির সংস্থাগুলো পরবর্তী পর্যায়ে অনুসরণ করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং মিশনারিদের মধ্যে সৌহার্দ্যের বাতাবরণ তৈরি হয় ও আত্মপ্রকাশের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। 1757 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানি এবং মিশনারি সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
মূল্যায়ন
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকাল বলতে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে অর্থাৎ পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে পদার্পণের সময় থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অর্থাৎ 1854 খ্রিস্টাব্দের উডের ডেসপ্যাচের সময় পর্যন্ত ধরা হয়। এই সময়ে বিদেশি মিশনারিগণ এই উপমহাদেশের শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।আবার, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অপর এক ‘দেশীয় শক্তি’ ভারতে শিক্ষাবিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দেশীয় শক্তির প্রতিনিধিদের মধ্যে, যে সমস্ত স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অন্যতম হলেন—রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডেভিড হেয়ার, ড্রিংকওয়াটার বেথুন, ডিরোজিও প্রভৃতি ।
এই সমস্ত বরণীয় মহাপুরুষের অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, যার সুদূরপ্রসারী ফলের প্রতিফলন পরবর্তী সময়ের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে জনশিক্ষার প্রসারে যে ত্রিমুখী শক্তি — মিশনারি, সরকারি ও দেশীয় শক্তি কাজ করেছিল, তাদের মধ্যে মতপার্থক্যের জন্য এই সময়কালকে বলা হয় ‘Period of Controversies অর্থাৎ মতবিরোধের কাল’। তবে উত্থান ও পতনের বহুপথ অতিক্রম করে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তাই নতুন নতুন বহু উন্নয়নমুখী চিন্তাভাবনার জন্মদাতারূপে এই কালকে ইতিহাসে মিশনারি প্রচেষ্টার ‘সুবর্ণ যুগ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ভারতে মিশনারিদের অবদান অনস্বীকার্য।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .