ভারতে নারীশিক্ষার বিবর্তন
মুখবন্ধ
ভারতে নারীশিক্ষার বিবর্তন সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে হলেই প্রাচীন ভারতের নারীশিক্ষার প্রেক্ষাপটেই তা করা উচিত। আর এজন্য প্রাচীন বৈদিক ভারতে স্ত্রী-শিক্ষার অধিকার যে সম্পূর্ণ মানা হত তা জানিয়েই এই উত্তর আরম্ভ করা হচ্ছে।
প্রাচীন ভারতে স্ত্রীশিক্ষা
অনেকেই জানেন যে প্রাচীন ভারতে স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে এক গৌরবময় অধ্যায় তৈরী হয়েছিল। স্ত্রী-জাতি সে সময়ে সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের সাথে শিক্ষার অধিকারও ভোগ করত। ঋষি নারীকে সেকালে ঋষিকা বা ব্রহ্মবাদিনী বলে অভিহিত করা হত। রমলা, লোপামুদ্রা, ঘোষা, জহু, পৌলমী, জরিতা, উর্বশী, ইন্দ্রাণী, অপালা, বিশ্ববারা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, দেবযানী, সাবিত্রী প্রভৃতি ছিলেন এই ধরনের ঋষিকা।
যাহোক সে সময়ে নারীদের ঋত্বিক হওয়ার যেমন পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও ছিল উপনয়নের অধিকার এবং এই অধিকার খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী অবধি অটুট ছিল। এ সময়ে বিয়ের পরেও শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
সূত্রযুগে নারীশিক্ষা
সূত্রযুগে বৈদিক সমাজে ঘরে বাইরের বিভিন্ন কারণে নানান পরিবর্তনের সাথে সাথে রক্ষণশীলতা সামাজিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করলে নারী স্বাধীনতার পরিবর্তে রক্ষণশীলতা আত্মপ্রকাশ করে এবং নারী-স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বস্তুত ‘মনু যুগের’ আগে পর্যন্ত নারীশিক্ষার ধারা অব্যাহত থাকলেও ‘‘মনুর যুগ’ থেকে নারীশিক্ষার ধারায় আসে নিম্নগতি।
বৌদ্ধযুগে নারীসমাজ
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে বৌদ্ধ যুগে নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে উদার চেতনার অভাব থাকলেও বৌদ্ধ যুগেও বহু গুণী নারীর সন্ধান মেলে। ভিক্ষুণী সুলভা, শ্রমণী শবরী, সুপ্রিয়া, আম্রপালী প্রভৃতি হচ্ছেন এমনই গুণসম্পন্না
ইসলামীয় পরিবেশে নারীশিক্ষা
নারী স্বাধীনতার এই অবস্থা কিন্তু বিশেষভাবে খারাপ হতে থাকে হুণ আক্রমণের পরে, বিশেষত আরবি-তুর্কি অভিযানের দরুন। তবে ইসলামি অনুশাসনে নারীশিক্ষাকে অবৈধ ভাবা হয়নি। হজরত মহম্মদ তো নারীশিক্ষাকে আবশ্যিক হিসাবে বিবেচনা করার উপদেশ দিয়েছেন।
পরবর্তীকালে সামাজিক অবক্ষয়ের সাথে সাথে তাই নারীশিক্ষার ঐতিহ্য অবলুপ্তির পথে পড়লেও নারীশিক্ষার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটেছিল একথা সঠিক নয়। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং ইংরেজদের আবির্ভাবের মধ্যে যে ভাঙাগড়ার যুগ আসে তখন থেকেই স্ত্রীশিক্ষা বহুলাংশে অবদমিত হতে থাকে।
ইংরেজদের আমলে নারীশিক্ষা
ইংরেজদের কেরানি তৈরিও কোম্পানির প্রয়োজনীয় কর্মচারী সৃষ্টির জন্য কোম্পানি থেকে যে শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেখানে যেহেতু মেয়েদের কর্মচারী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না সেজন্য নারী শিক্ষার জন্য ভাবনার কোনো অবকাশই ছিল না। উইলিয়াম অ্যাডামের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে প্রতি ৫ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৪ জন নারীর অক্ষরজ্ঞান লক্ষ্য করা গেছে।
বেসরকারি উদ্যোগে নারীশিক্ষা
মিশনারিরা ছাড়া ঐ সময়ে বেসরকারি উদ্যোগেও কিছু মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপন করে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মেয়েদের যারা মিশনারি স্কুলে যেতে চাইত না তাদের শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এভাবে বাংলাদেশ, বোম্বাই প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রচেষ্টায় কিছু মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মগনভাই করমচাদের ২০ হাজার টাকার সাহায্যে দুটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। অধ্যাপক পত্তনের সহায়তায় বোম্বাইতে ‘স্টুডেন্ট লিটলারি সায়েন্টিফিক সোসাইটি’র তত্ত্বাবধানে ৯টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের নতুন যুগ আসে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দশ হাজার পাউন্ড সাহায্যের ফলে, বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর।
বেন্টিঙ্কের পরে নারীশিক্ষা
নারীশিক্ষা প্রসারে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক উৎসাহী ছিলেন এবং রাজা রামমোহনের সাহায্যে ভারতে নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা নেন এবং সতীদাহ প্রথা আইন করে বন্ধ করেন। বেন্টিঙ্ক ছাড়া লর্ড ডালহৌসীও নারীশিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখান এবং বেন্টিঙ্ক ও ডালহৌসীর যৌথ প্রচেষ্টায় ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উডের (Charles Wood) শিক্ষা দলিলে নারীশিক্ষার বিস্তারে সরকারি সাহায্য দেওয়ার দায়িত্ব স্বীকার করা হয়।
সিপাহী বিদ্রোহের পর নারীশিক্ষা
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোেহর পর নারীশিক্ষার কিছুটা জোয়ার আসে এবং এ ব্যাপারে সরকারি সাহায্য বেড়ে যায়। এরই ফলে এসময়ে পার্শি সমাজের উদ্যোগে বোম্বাইতে এবং বাংলাদেশের ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টায় মেয়েদের শিক্ষা আন্দোলন বাড়তে থাকে।
এর ফলে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতে মেয়েদের জন্য ১৭৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৩৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার প্রসারে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বেথুন স্কুলে মেয়েদের মহাবিদ্যালয় খোলা হয়। এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পালাম কোটায় একটি কলেজ খোলা হয়েছিল।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রথম শিক্ষা পাওয়ার অধিকার মেলে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকের গোড়ায় ভারতে একমাত্র বেথুন কলেজে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হত। তবে এ সময়ে ঐ স্তরে ছাত্রীসংখ্যা ছিল খুবই কম—মাধ্যমিক শিক্ষায় ছাত্রীসংখ্যা ছিল দু’হাজারের কিছু বেশি।
এ সময়ে শিক্ষক ১ কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ বাড়ে এবং মিশনারির এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেন। তবে এর কিছু আগে রাজা রামমোহন রায়ের সাহায্যে মিস কার্পেন্টার নিজ প্রচেষ্টায় একটি প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় লেন; সেখানে মেয়েদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .