প্রাচীন যুগ বা বৈদিক যুগে নারী শিক্ষা
বৈদিক যুগে মহিলারা যথেষ্ট স্বাধীনতা পেতেন। তাঁরা শিক্ষা অর্জন করতে পারতেন, যাগযজ্ঞেও অংশগ্রহণ করতে পারতেন। এমনকি তাঁরা বৈদিক জ্ঞান অর্জন করার অধিকারীও ছিলেন। মুনি ঋষিদের কন্যারা আবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমপরিমাণ বিদ্যা অর্জন করতে পারতেন। ২০০ খ্রি. পূর্বের আগে উপনয়ন মেয়েদের ক্ষেত্রেও বহুল প্রচলিত ছিল। এর নমুনা আমরা পাই বানভট্টের লেখা “কাদম্বরী” তে মহাশ্বেতা চরিত্রে। মেয়েদের শুধুমাত্র পৈতে পরার অধিকারই ছিল না, গুরুভাইদের সঙ্গে বেদ, বেদাঙ্গ পাঠ করার সুযোগও ছিল সমান। মাধবাচার্যের লেখাতে ছেলেদের মতই ৮ বৎসরে মেয়েদের উপনয়নের উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্ঞানী মহিলাদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হত, যেমন “ঋষিকা” (অর্থাৎ যিনি ঋষিদের মতই মন্ত্রস্রষ্টা হওয়ার অধিকারিণী) “ঋত্বিকা” (যিনি যজ্ঞের অধিকারিণী) “ব্রহ্মবাদিন” (যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন), “মন্ত্রনীদ” বা “মন্ত্রদূক” (যিনি মন্ত্র বা বৈদিক জ্ঞান অর্জন করেছেন) “পণ্ডিত” ইত্যাদি। রামায়ণ এবং মহাভারতে কুন্তি, কৌশল্যা, তারা, দ্রৌপদী ইত্যাদি নামের সঙ্গে “ঋত্বিকা” এবং ‘মন্ত্রনীদ” শব্দের উল্লেখ দেখা যায়।
“উত্তর রামচরিত” এ বাল্মীকির আশ্রমে রামের ছেলে লব-কুশের সঙ্গে আত্রেয়ীর বেদান্ত পাঠের উল্লেখ আছে।
“বৃহদারণ্যক উপনিষদ”-এ জনক রাজ্যে, রাজা বিদেহর রাজসভায় গার্গী এবং যাজ্ঞবন্ধ্যের মধ্যে তর্কবিদ্যার লড়াইয়ের উল্লেখ দেখা যায়। এবং সেখানে এটাও দেখা যায় যে গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যকে তর্কে হারিয়েছিলেন।
উপনিষদে বেশ কিছু মহিলা শিক্ষিকার নাম পাওয়া যায়, যেমন—সুলভা, প্রথিতেয়ী, মৈত্রেয়ী, কার্যকাশিনী ইত্যাদি। পাণিনির লেখাতেও “ছাত্রীশালা” (ছাত্রীদের জন্য বাসস্থান) “আচার্যিনী” অর্থাৎ মহিলা শিক্ষিকার উল্লেখ দেখা যায়।
মহাকাব্যের যুগেও এই প্রথা চলতে থাকে। শুধু দর্শন বা তর্কশাস্ত্রেই নয়, মেয়েরা নানা রকম শিক্ষা অর্জন করতেন। যেমন মেয়েদের সামরিক বিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছিল না। মহাভারতে অর্জুনের নির্বাসন কালে চিত্রাঙ্গদার নাম আমরা পাই একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে। সুভদ্রা ছিলেন একজন দক্ষ রথ-চালক বা সারথি। মৃদগলিনী রথ পরিচালনা করতেন এবং সশস্ত্র হয়ে দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। বিসপালা যুদ্ধে তাঁর একটি পা হারান, এবং অশ্বিনীর কৃপায় কৃত্রিম লৌহ পা ব্যবহারে সক্ষম হন।
পাণিনি বলেছেন যে সকল নারীগণ কণ্ঠ উপনিষদে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তাদের বলা হত “কণ্ঠী”, কল্পতে যাঁরা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের বলা হত “কল্পী”। পাতঞ্জলী মহিলা শিক্ষিকাদের “ঔষমেধা” এবং শিক্ষার্থীদের “ঔধামেধী” বলে উল্লেখ করেছেন। মহিলারা তর্কসভায় বিচারকের আসনও গ্রহণ করতেন। যেমন শঙ্করাচার্যের সঙ্গে মদন মিশ্রের তর্কসভার বিচারক ছিলেন মদন মিশ্রের স্ত্রী উদয়ভারতী।
সামরিক শাস্ত্রে দক্ষ মহিলা বল্লভরাজকে বলা হত “শক্তিনী”। কথিত আছে যে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সভায় মহিলা রক্ষীরা ছিলেন।
প্রাচীন ভারতে মহিলারা নানা কলায় জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পেতেন। কিছু কলা ছিল যেগুলিতে তাঁরা বিশেষ দক্ষতা দেখাতেন যেমন—রন্ধন কলা, অঙ্কন, নৃত্য, সংগীত, সেলাই, সীবন শিল্প, বয়ন, তাঁতের কাজ ইত্যাদি।
অথর্ব বেদে বলা আছে যে ব্রহ্মচর্য সমাপন না করলে একজন কুমারী বিবাহযোগ্য হিসাবে গণ্য নয়। মেয়েদের বেদ ও বিজ্ঞান চর্চা করে নিজেদের চরিত্র গঠন করে তবেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া উচিত। তখন মেয়েদের বিবাহযোগ্য বয়স ধরা হত ১৬-১৭ বৎসর। শুধু তাই নয়, মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারও পেত। বিবাহ পরবর্তী সময়েও মেয়েরা চাইলে তাদের লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে পারত।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে থাকল এবং তার প্রভাব দেখা যেতে লাগল নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও। মনুর যুগ থেকে নারীর সামাজিক মর্যাদা কমে যেতে লাগল এবং নারী শিক্ষার অবনতি হতে লাগল। এই সময় সামাজিক শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধ কঠোর ভাবে প্রয়োগ হতে শুরু করে এবং সমাজ ক্রমশ আচার সর্বস্বতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মনুষ তাঁর বিধানে মেয়েদের বিবাহকে বৈদিক পাঠের সমতুল্য, স্বামী সেবাকে আশ্রমিক জীবনের সমান এবং গৃহকর্মকে সন্ধ্যা প্রার্থনার সমতুল হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়ে মেয়েদের সামাজিক স্বাধীনতা ও শিক্ষা লাভের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। তিনি ভারতীয় মেয়েদের পরাধীন অন্তঃপুরে নির্বাসিত জীবনযাত্রার পথিকৃৎ ছিলেন। মনু রচিত স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী কুমারী অবস্থায় কন্যারা থাকবে পিতার অধীনে, বধু অবস্থায় স্বামীর অধীনে এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে। তাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবন বলে আর কিছু থাকবে না।
মনু পরবর্তী সময়ে মেয়েদের বিবাহের বয়স নেমে আসে ১০-১২ বছরে। এতে তাদের ধর্মীয় মর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা, এবং শিক্ষালাভের সুযোগের `দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। উপনয়ন বা গুরুগৃহে বৈদিক রীতি অনুযায়ী বিদ্যারম্ভ থেকে মেয়েরা বঞ্চিত হতে থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং যজ্ঞস্থানে তাঁদের অধিকার হ্রাস পেতে থাকে। মধ্যবিত্ত সমাজের মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হতে ক্রমশ পুরুষের আজ্ঞাধীন অন্তঃপুরে বন্দিনির জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে, গৃহকর্ম শিক্ষা, রন্ধন শিক্ষা, সংগীত ও অঙ্কন শিক্ষা তারা তাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে অপ্রথাগত শিক্ষার মাধ্যমে অনুকরণ, মৌখিক নির্দেশ, শিক্ষানবিশ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জন করতে পারত। সেক্ষেত্রে নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার কোন সুযোগ বা ক্ষমতা থাকত না।
বর্ধিষ্ণু এবং রাজ পরিবারের মেয়েরা অবশ্য তখনো শিক্ষার সুযোগ পেতেন। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় পাঠ, কাব্য চর্চা, গৃহকর্ম শিক্ষা, রন্ধন শিক্ষা, সংগীত-কলা ও অঙ্কন শিক্ষা অর্জনের সুযোগ তখনও তাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .