মানব সমাজে বিবাহ হল বিশ্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠান। মানুষ পূর্বে অসভ্য অবস্থায় যখন বিচরণ করত তখন আজকালকার মত এক সামাজিক অনুষ্ঠান হিসাবে বিবাহপ্রথা চালু ছিল না। কিন্তু তখনও যৌন আকাঙ্খা তৃপ্তি ও শিশু প্রতিপালনের জন্য স্ত্রী-পুরুষকে একসঙ্গে থাকতে হত, যদিও এ ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না। পশু-পক্ষীরাও শিশু সন্তান পালনের জন্য স্ত্রী-পুরুষ বেশ কিছুকাল একসঙ্গে বাস করে। যে পশু বিবর্তনের ধারায় যত উন্নত তার শৈশবকাল তত দীর্ঘ এবং শিশু সন্তানকে লালন পালনের জন্য সেই পশুগুলি তত বেশী কাল একসাথে বাস করে। মানবশিশুর শৈশব সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সেজন্য মানবসমাজে পিতামাতাকে অনেকদিন একসাথে বাস করতেই হবে। এই জৈবিক প্রয়োজন থেকে গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং গোষ্ঠীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য বিবাহ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে উদ্ভূত হয়েছে। পরে এই বিবাহ ব্যবস্থার সাথে অন্যান্য মানসিক চিন্তাধারা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি যুক্ত হয়েছে এবং মানুষ বুঝতে শিখেছে যে বিবাহ বন্ধন শুধু জৈবিক ও যৌন প্রয়োজন মেটাবার জন্য নয়, এর পিছনে উন্নততর ও মহত্তর সত্য নিহিত আছে। বিবাহ বন্ধন একটি পবিত্র বন্ধন এবং এই পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখবার দায়িত্ব নারী ও পুরুষ উভয়েরই।
রাসেলের মতে পুত্র কন্যার জন্ম দেওয়া ও তাদের মানুষ করার ব্যাপারে নারীপুরুষের সানন্দ সহযোগিতাই বিবাহের প্রধান কারণ। ওয়েস্টারমার্ক বলেন বিবাহ হল স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে অল্পবিস্তর স্থায়ী সম্পর্ক যার উদ্দেশ্য হল পুত্রকন্যার জন্ম দেওয়া, কিন্তু এই সম্পর্ক পুত্রকন্যা জন্মগ্রহণ করার পরই শেষ হয়ে যায় না, একজনের মৃত্যু হলে এর অবসান হয়। বিবাহ এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক সমাজে অনুমোদন লাভ করে; এটি পারিবারিক জীবন যাপনের জন্য বৈধ, দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক মিলন বলা যায়।
বিবাহের অন্যতম মূল ভিত্তি হল স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্কই যথেষ্ট নয়, উভয়েই চায় সান্ত্বনা ও সহানুভূতি। এর ফলে গড়ে ওঠে পরিবার।
বিবাহ ও পরিবার—এই দুটি ধারণা পরস্পর থেকে অবিচ্ছিন্ন। বিবাহের সাথে যেহেতু পরিবারের ধারণা অবিচ্ছিন্ন সেজন্য বুঝা যায় যে বিবাহ শুধু একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, এর সাংসারিক ও সামাজিক তাৎপর্যও আছে। শিশুর বৃদ্ধি ও কল্যাণ সাধন বিবাহের লক্ষ্য। শিশু যদি না থাকত তাহলে নারী পুরুষের সম্বন্ধ সহজেই ভেঙে যেত।
বিবাহের দৈহিক দিক ছাড়াও মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক আছে। বিবাহ শুধু দৈহিক সুখলাভের জন্য নয়। এখানে ভোগ ও ত্যাগ উভয়েই একসাথে কাজ করে। বৈবাহিক জীবনে স্ত্রী ও পুরুষকে প্রচুর স্বার্থত্যাগ করতে হয়; দুজনেই যদি শুধু নিজের স্বার্থচিন্তা করে তাহলে পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ যখন দৈহিক সম্পর্কের ঊর্দ্ধে কোন উচ্চতর ও মহত্তর মানসিক, নৈতিক ও শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক সত্তা সম্পর্কে সচেতন হয় তখনই প্রকৃতপক্ষে বিবাহ এক উচ্চতর আদর্শের প্রতিফলন রূপে স্থাপিত হয়। তখন শেষ পর্যন্ত দুজনের সত্তা যেন মিলিত হয়ে একাত্মতা লাভ করে। এটিই হল বিবাহের প্রকৃত আদর্শ।
অবশ্য বিবাহরূপ সম্বন্ধ যেহেতু সমাজের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এবং স্ত্রী ও পুরুষ যেহেতু অশরীরী আত্মা নয়, সেজন্য কতকগুলি অর্থনৈতিক প্রয়োজনের কথা স্বাভাবিক ভাবেই ওঠে। জীবন ধারণের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন। সাধারণভাবে সংসারে পুরুষই এই অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করে এবং স্ত্রী পরিবারের মধ্যে থেকে শিশুদের ও স্বামীর অন্ন, বস্ত্র প্রভৃতির ব্যবস্থা করে। এই স্বামী ও স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় সংসার কার্য নির্বাহিত হয়। অনেকে বিবাহের অর্থনৈতিক দিকটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এটিকেই বিবাহের প্রকৃত ভিত্তি বলে মনে করেন। অর্থনৈতিক দিকটি পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বটে, কিন্তু এটিকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে করা ভুল। মার্ক্সীয়গণ সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক বিবর্তনকে অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার দ্বারা শ্রেণী সংগ্রামের নীতির দ্বারা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন। বলা বাহুল্য তার প্রচেষ্টা সফল হয় নি। তেমনি বিবাহকেও শুধু অর্থনৈতিক দ্রিক দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। বিবাহের বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথা আছে, কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য একই এবং বিবাহ অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়াও, যৌন প্রয়োজন, শিশুসন্তান পালন, স্নেহভালবাসা, স্বার্থত্যাগ প্রভৃতি বহুপ্রকার মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
বিবাহ ব্যবস্থা হল মানবসমাজের প্রাচীন, সর্বব্যাপী ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান (Social Institution)। এটি সহস্র সহস্র বৎসর ধরে সমাজের ঐক্য, সংহতি ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। কিন্তু আজকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে এই ঐক্য বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা নিয়ে গঠিত হয় পরিবার এই ধারণার মধ্যে বিরাট সংশয় দেখা দিয়েছে। One parent family আমাদের দেশে এখন বিশেষ না দেখা গেলেও পাশ্চাত্যে এটির বহু দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে এবং gay marriage, lesbiam marriage (পুরুষ-পুরুষ বিবাহ, নারী-নারী বিবাহ) সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে- এ আশঙ্কা অমূলক নয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .