ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) কারণ
কোন সমাজব্যবস্থা যখন দুর্নীতিগ্রস্ত ও গতিহীন হয়ে পড়ে, তখন সমাজের মধ্যে থেকেই নবজাগ্রত কোন শক্তির আঘাতে তা ভেঙে যায়। ফরাসী দেশের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে ফ্রান্সে যে সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অর্থব্যবস্থা বহাল ছিল, তার সঙ্গে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাই রিক্ত, নিঃস্ব এবং ক্ষুব্ধ ফরাসী জনগণ বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্বে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গড়তে অগ্রসর হন। শুরু হয় ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রীঃ)।
ফরাসী বিপ্লবের সামাজিক কারণ
ফরাসী বিপ্লবের জন্য ফরাসী সমাজব্যবস্থার বৈষম্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। অষ্টাদশ শতকে ফরাসী জনগণ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা—যাজকশ্রেণী, অভিজাতশ্রেণী এবং তৃতীয়শ্রেণী। যাজক ও অভিজাত শ্রেণী যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী রূপে গণ্য হত। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্ত জনগণ ছিল ‘অধিকারভোগী’ এবং তৃতীয়শ্রেণী ছিল ‘অধিকারহীন’।
যাজকশ্রেণী
যাজকশ্রেণী ছিল বিলাসবহুল জীবনযাত্রার অধিকারী। মোট যাজকের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষের মত। সম্প্রদায় হিসেবে যাজকদের প্রভূত প্রতিপত্তি ছিল। ধর্ম ছাড়াও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এদের দারুণ প্রভাব ছিল। প্রতিটি চার্চের প্রচুর সম্পত্তি ছিল। এইসব সম্পত্তির আয় ছিল যথেষ্ট। এছাড়া ‘টির্থ’ নামক একপ্রকার কর চার্চ আদায় করত। শিক্ষাব্যবস্থার উপর চার্চের নিয়ন্ত্রণ ছিল সীমাহীন। সব মিলিয়ে ফ্রান্সের চার্চ ও যাজকগণ ছিলেন বিত্তশালী ও সম্পদশালী দুটি প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী। তবে A. Sieyes প্রমুখ সমস্ত যাজককে একই শ্রেণীভুক্ত করতে অস্বীকার করেছেন। বিশপ বা উচ্চ-যাজকরা সম্পদশালী হলেও নিম্ন-যাজকদের অবস্থা সচ্ছল ছিল না। তাদের সামাজিক কোন প্রতিপত্তি ছিল না। দারিদ্র্যজর্জরিত নিম্নযাজকেরা তাই প্রথম থেকেই ফ্রান্সের প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। বিপ্লব শুরু হলে এই গোষ্ঠী বিপ্লবের অংশীদার হতে দ্বিধা করেনি।
অভিজাত শ্রেণী
অভিজাতশ্রেণী ছিল মোট ফরাসী জনসংখ্যার ১ বা ১.৫ শতাংশ। রাজা বা রানীর আত্মীয়পরিজন এবং উচ্চবংশীয় ব্যক্তিরা অভিজাত হিসেবে গণ্য হতেন। অর্থাৎ অভিজাত জন্মসূত্রে অর্জন করা যেত। তবে রাজা উচ্চরাজপদে নিয়োগ করে কোন ব্যক্তিকে ‘অভিজাত’র মর্যাদা দিতে পারতেন। এদের বলা হত ‘পোশাকী অভিজাত’। সাধারণভাবে জন্মসূত্রে সৃষ্ট অভিজাতরা পোশাকী অভিজাতদের হীনচোখে দেখত। অবশ্য ক্রমে এই ব্যবধান কমে গিয়েছিল। এরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করত। এদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগের উচ্চপদ এবং জমিদারীর আয়। এরা ফ্রান্সের কৃষিজমির প্রায় এক-পঞ্চমাংশের মালিক ছিল। অথচ এই জমির দরুন প্রদেয় কর ‘টেইলি’ এরা দিত না। অন্যান্য কোন প্রকার কর এবং দিতে বাধ্য ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাথে এরা ভোগ করত বিরাট সামাজিক মর্যাদা। তবে অভিজাতদের সকলের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ব্যয়বৃদ্ধির ফলে এরা কঠোরভাবে কর আদায় করতে উদ্যোগী হয়। এদের রাজনৈতিক কিছু ক্ষোভও ছিল। আসলে এই পরগাছাশ্রেণীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজেদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখা এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করা। ষোড়শ লুই-এর রাজত্বকালে এই শ্রেণীর দত্ত ও উন্নাসিকতা সাধারণ মানুষকে বিপ্লবমুখী করে তোলে।
তৃতীয়শ্রেণী
তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল কৃষক, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি। এরা ছিল ফরাসী জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশ। তৃতীয় সম্প্রদায়ের উপরের অংশ ‘বুর্জোয়া’ নামে পরিচিত ছিল। এরা ছিল বুদ্ধিমান ও সমাজ সচেতন। দার্শনিকদের উদার ভাবধারা এদেরই প্রথম আকৃষ্ট করে এবং বিপ্লবের উদ্বুদ্ধ করে তোলে। বুর্জোয়াদের আর একটি অংশ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত ছিল, এদের প্রভূত সম্পদ ছিল, কিন্তু অভিজাতদের মত সামাজিক মর্যাদা ছিল না। এছাড়া ছিল বড় বড় ব্যাঙ্ক ও শিল্পকারখানার মালিক। এরাও প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী ছিল। কিন্তু এদেরও কোন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বা সামাজিগক মর্যাদা ছিল না। সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্যই এরা বিপ্লবের অংশীদার হয়েছিল। তাই নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “অহমিকাই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ- স্বাধীনতা ছিল অজুহাত মাত্র।”
কৃষক-শ্রমিক-কারিগর
তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিরাট অংশ ছিল কৃষিজীবী এদেরও অবস্থা তারতম্য ছিল। কেউ কেউ নিজস্ব জমির মালিক, কেউ আবার বেশীর ভাগ কৃষিশ্রমিক। এরা ছিল প্রকৃত অর্থেই ‘গ্রামীণ সর্বহারা’। অধিকাংশ দিনই এদের খাবার জুটত না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরাট করের বোঝা এদেরই বহন করতে হত। একজন কৃষককে তার আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ কর দিতে হত। বাকী ২০ শতাংশ জীবনধারণ ছিল অসম্ভব। কৃষক ছাড়া কারিগর, দোকানদার, কায়িক শ্রমনির্ভর সাধারণ মানুষ প্রভৃতির জীবনযাত্রাও ছিল শোচনীয়। ভ্রান্ত অর্থনীতির ফলে এদের অবস্থা দিন দিনই খারাপ হতে থাকে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকাংশ শ্রমিকই ক্ষুধানিবারণের জন্য ছুটির দিনে ভিক্ষা চাইতে গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ত।’ দেশের এই আর্থিক অবক্ষয় ও তজ্জনিত দুরবস্থা সাধারণ মানুষের খুব সহজেই বিপ্লবে আকৃষ্ট করে।
ফরাসী বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ
রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের মত ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ছিল বৈষম্যে পরিপূর্ণ। এক কথায় ‘ফ্রান্স ছিল ভুল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক প্রকাণ্ড জাদুঘর’।
করের বোঝা
তখন ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ কর ছিল তিন প্রকার, যথা—টেইলি, ক্যাপিটেশন ও ভিংটিয়েমে। ফ্রান্সের যাজক ও অভিজাতগণ দেশের অধিকাংশ সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও এই কর দিত না। কেবল জমি থেকেই চার্চের বার্ষিক আয় হত ১৩ কোটি লিভ্র। টিথ্ থেকেও আসত বহু অর্থ। অথচ তারা রাষ্ট্রকে দিত একটি ‘খুশিমত দান’, যার পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য। অভিজাতরাও ‘টেইলী’ বা বাধ্যতামূলক অন্যান্য কর দিত না। অপর দুটি কর থেকেও তারা রেহাই পেয়ে যেত। কিন্তু তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে সব করই যথাযথভাবে প্রদান করতে হত। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের উৎপীড়নের ফলে অনেক সময় অতিরিক্ত করও দিতে হত রাজাকে, দিতে হত ‘টেইলী’ নামক মোট আয়ের উপর কর, ‘ক্যাপিটেশন’ বা উৎপাদনভিত্তিক আয়কর, ভিংটিয়েমে বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর ধার্য কর। পরোক্ষ করের মধ্যে ছিল ‘গেবেলা’ বা লবণকর, ‘এইস’ বা ভোগ্যপণের উপর কর প্রভৃতি। এছাড়া চার্চ ও সামন্তপ্রভুদের জন্যও তাদের কর দিতে হত। চার্চকে দিতেহত ‘টিপ্’ বা ফসলের এক-দশমাংশ। সমান্তপ্রভুকে দিতে হত পথ-ঘাট ব্যবহারের জন্য ‘তেরাজ’, কলে শস্য ভাঙানোর জন্য ‘ব্যানালাইট’, জমি হস্তান্তরের জন্য ‘লদ-এ-ভঁঙ’, ম্যানরের জমিচারের জন্য ‘ঈ’ ইত্যাদি। অথচ কৃষকদের আয় দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির উপর চাপ বেড়েছিল দারুণভাবে। কৃষিব্যবস্থাও ছিল পশ্চাৎপদ। এমতাবস্থায় করের দুঃসহ বোঝা কৃষকদের ক্রমান্বয়ে রাজতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রের তীব্র বিরোধী করে তোলে।
সরকারী অপব্যয়
সরকারী অপব্যয় ও রাজপরিবারের বিভাগবাসর ফরাসী অর্থব্যবস্থাকে একেবারেই পঙ্গু করে দেয়। পঞ্চদশ লুই-এর আমলে উপর্যুপরি যুদ্ধ তজ্জনিত কারণে বিরাট সেনাবাহিনীর পোষণ এবং বিশালসংখ্যক কর্মচারীর বেতন ও ভাতা দিতেই সব রাজস্ব খরচ হয়ে যেত। শুধু রাণীর খাস-চাকরের সংখ্যাই ছিল ৫০০ জন। ফলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ১৭৮৮ সালে কেবল ঋণের সুদ বাবদই ৩১ কোটি ৮০ লক্ষ ‘লিভ্র’ খরচ হয়েছিল।
ভ্রান্ত অর্থনীতি
ভ্রান্ত অর্থব্যবস্থা দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি করে। তার উপর অভূতপূর্ব শিলাবৃষ্টি ও ঝড় (১৭৮৮ খ্রীঃ) প্রচুর পরিমাণে শস্যহানি ঘটায়। শুরু হয় রুটির জন্য দাঙ্গা। মর্স স্টিফেন্স তাই বলেছেন, “ফরাসী বিপ্লবের কারণ ছিল প্রধানত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক–দার্শনিক বা সামাজিক নহে।”
দার্শনিকদের অবদান
বস্তুত ফ্রান্সের সমগ্র ব্যবস্থাটাই ছিল অচল। রাজতন্ত্রের স্বৈরাচার ও দুর্বলতা, সামাজিক অসাম্য ও অত্যাচার, অর্থনৈতিক সংকট সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষকে প্রচলিত ব্যবস্থা ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। উচ্চ-বুর্জোয়াগোষ্ঠীভুক্ত বণিক, শিল্পপতি প্রমুখ এই সুযোগে তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়। অভিজাতশ্রেণীর ভ্রান্ত বুদ্ধি রাজার সমস্ত সংস্কার কর্মসূচীকে বানচাল করে দিয়ে নিজেদের পায়ের নীচের মাটি সরিয়ে দেবার খেলায় মেতে ওঠে। সমস্ত দিক যখন প্রস্তুত, তখন ফরাসী দার্শনিকরা প্রচলিত অসাম্যের প্রতি বুদ্ধিজীবীশ্রেণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, ডিডেরো, ডি-এলেমবার্ট প্রমুখ দার্শনিক রাজনীতি, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতির মুখোশ খুলে দিয়ে শিক্ষিত মানুষদের ও সাধারণের নিপীড়িত ফরাসীবাসীকে অধিকার সচেতন করে তোলেন। এখন প্রয়োজন ছিল শুধু বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগের। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘স্টেট্স জেনারেল’ আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে সে কাজও সম্পন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফরাসী বিপ্লবের।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .