টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস এই দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে ছােট্ট দেশটি ছিল প্রাচীন গ্রিকরা তার নাম দিয়েছিল মেসােপটেমিয়া। মেসােপটেমিয়া বলতে যে অঞ্চলকে বােঝাত তার উত্তরদিকে ছিল আসিরিয়া এবং দক্ষিণদিকে ছিল ব্যাবিলনিয়া। এই ব্যাবিলনিয়ার উত্তর অংশের নাম ছিল আক্কাদ আর দক্ষিণ অংশের নাম ছিল সুমের। এই সুমেরকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার নাম ছিল সুমেরীয় সভ্যতা।
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার নানাদিক
নগরজীবন
নগর পরিকল্পনা
সুমেরীয় সভ্যতায় একাধিক নগর ও জনপদ গড়ে উঠেছিল। খননকাজের দ্বারা প্রাপ্ত এই অঞ্চলের বাড়ি, মন্দির এবং রাস্তাঘাটগুলির ধ্বংসাবশেষ-এ সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ মেলে।
শাসন পরিচালনা
সুমেরীয় নগরগুলিতে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। অনেক ক্ষেত্রে পুরােহিত শ্রেণি সুমেরীয় নগরগুলির শাসন পরিচালনা করত। প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্যের লক্ষ্যে অভিজাতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল এক কাউন্সিল।
সমাজ কাঠামাে
প্রাচীন সুমেরীয় সমাজ কাঠামাে তিনভাগে বিভক্ত ছিল।
1. উচ্চশ্রেণি , সমাজে উচ্চশ্রেণিভুক্ত ছিল পুরােহিত, অভিজাত, বণিক, শিল্পপতি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীগণ।
2. মধ্যশ্রেণি , এই শ্রেণিভুক্ত ছিল চিকিৎসক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ।
3. নিম্নশ্রেণি , দাস ও সাধারণ শ্রমিকরা ছিল এই শ্রেণিভুক্ত। প্রাচীন সুমেরীয় সমাজে যুদ্ধবন্দিরাই দাস হিসেবে বিবেচিত হতাে।
অর্থনৈতিক কাঠামাে
সুমেরের অর্থনৈতিক কাঠামাে নির্ভরশীল ছিল কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসা-বাণিজ্যের ওপর।
কৃষি
i) উৎপাদিত ফসল : সুমেরবাসীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজ ফসল ফলত। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর জল থেকে কৃষকরা সেচের চাহিদা মেটাত। তাদের প্রধান কয়েকটি কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব প্রভৃতি। সুমেরে বিভিন্ন শাকসবজি আর খেজুরও যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হতাে।
ii) খেজুরের গুরুত্ব : খেজুর গাছ থেকে সুমেরবাসীর বিভিন্ন চাহিদা মিটত বলে তারা খেজুর গাছকে জীবনবৃক্ষ বা প্রাণবৃক্ষ বলত।
পশুপালন
সুমেরবাসীর অপর একটি জীবিকা ছিল পশুপালন। সুমেরবাসীর প্রধান কয়েকটি গৃহপালিত পশু ছিল গােরু, ছাগল, ভেড়া। এই গৃহপালিত পশুগুলি থেকে তারা দুধ, মাংস, চামড়া ও পশম পেত। উন্নতমানের ভেড়ার পশম দিয়ে তারা দামি পশমি কাপড় বানাত।
ব্যাবসা-বাণিজ্য
কৃষি ছাড়া সুমেরীয় অর্থনীতির আর একটি উৎস ছিল বাণিজ্য। সুমেরীয় বণিকগণ বিক্রেতা নিয়ােগের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞলগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চালাত। বিক্রেতাগণ কমিশনের বিনিময়ে বণিকদের থেকে দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে বিক্রয় করত। প্যালেস্টাইন, ফিনিশিয়া, ক্রিট ও ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, এশিয়া মাইনর, প্রাচীন ভারত এবং প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সুমেরীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সাহিত্য
গিলগামেশ মহাকাব্য
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ সুমেরে গিলগামেশ মহাকাব্যটি রচিত হয়েছিল। এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য। এতে রাজা গিলগামেশের বীরত্ব, সাফল্য ও ব্যর্থতার কাহিনি রয়েছে।
সুমেরীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাণগুলি ছিল অন্যতম।
লিপি
পণ্ডিতদের অনুমান সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। এক্ষেত্রে তাদের লিপি ছিল দু’রকম। একটি ছিল চিত্রলিপি এবং অপরটি কিউনিফর্ম লিপি।
বিজ্ঞান
ধর্মীয় উৎসবগুলির সময়কাল বের করতে গিয়ে সুমেরীয়রাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটায়। তারা তারকা জলঘড়ি ও চন্দ্ৰপঞ্জিকা আবিষ্কার করে। চন্দ্রের আবর্তন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তারা বছরকে মাসে ভাগ করতে শেখে।
আইন
প্রাচীন সুমেরে অপরাধ, সম্পত্তি, বাণিজ্য, ঋণ, চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রচিত হয়েছিল।
শিল্পকলা
সুমেরীয়রা মৃৎশিল্প, ধাতু বা অলংকার শিল্প, বস্ত্রশিল্পে পারদর্শী ছিল। এছাড়াও তারা রােদে শুকানাে ইট দিয়ে স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। ধাতব দ্রব্য, খােদাই করা মূর্তি প্রভৃতি ভাস্কর্যে সুমেরীয় শিল্পকলা প্রতিফলিত হয়েছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .