অধ্যাপক বিনয় চৌধুরি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন। এই পর্বকে তিনি উগ্র জমিদারতন্ত্রের যুগ বলে অভিহিত করেছেন (period of high landlordism)। এই উগ্র জমিদারতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল দুটি—জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাধাদান এবং বৈধ এবং অবৈধ পথে খাজনা বৃদ্ধি। জমিদাররা প্রজার জমি হস্তান্তরকে (alienation) পছন্দ করত না কারণ তাদের ধারণা হয়েছিল এর ফলে গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে মহাজন, জোতদার ও সম্পন্ন কৃষকদের প্রভাব বাড়বে। জমিদারদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমে যাবে। দুটি কারণে জমিদাররা খাজনা বাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
পাবনা বিদ্রোহের কারণ
প্রথমত
কৃষকরা অবৈধ, বেআইনি আবওয়াব দিতে রাজি ছিল না, জমিদাররা নানা ধরনের আবওয়াব আদায় করত। সরকার কোনো নতুন সেস বা কর বসালে জমিদাররা তা কৃষকদের খাজনার সঙ্গে জুড়ে দিত। পথ সেস, শিক্ষা সেস, ডাক খরচ, আয়কর ইত্যাদি প্রজাদের কাধে চাপানো হয়েছিল। কৃষকরা সংঘবদ্ধভাবে এসব কর দিতে অস্বীকার করলে এগুলিকে মূল খাজনার সঙ্গে যুক্ত করে স্থায়ী করার চেষ্টা হয়। জমিদার সবসময় তার আয় বজায় রাখার প্রয়াস চালাত। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সরকার খাজনা বৃদ্ধির বিরোধিতা করে আইন পাশ করলে জমিদাররা ভয় পেয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল ভবিষ্যতে নতুন করে আর খাজনা বাড়ানো যাবে না। খাজনা বাড়ানোর চেষ্টা হলে জমিদার-প্রজা সম্পর্কে সংকট দেখা দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত
জমিদাররা নানাকারণে খাজনা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা সম্ভব হত না। জমিদারের ব্যয় বেড়েছিল কারণ তার পরিবারের আয়তন বেড়েছিল, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল, জমিদারি পরিচালনার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। বড়ো জমিদারিগুলি বহু খণ্ডে বিভক্ত হওয়ায় পরিচালন ব্যয় বেড়েছিল। সরকার জমিদারদের ওপর নানা ধরনের কর চাপিয়েছিল, আর সব জমিদার সমান উদ্যোগী ছিল না। তারা জমিদারির উন্নতি ঘটিয়ে আয় বাড়ানোর কথা ভাবেনি, আবার শিল্প-বাণিজ্যে অর্থ লগ্নি করে আয় বাড়ায়নি। তাদের আয় বাড়ানোর একমাত্র পথ ছিল কৃষকের উদ্বৃত্তের একাংশ আত্মসাৎ করা। ঐতিহাসিকরা পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ খুঁজেছেন জমিদারি শোষণ ও অত্যাচারের মধ্যে। এই শোষণ ও অত্যাচারের প্রমাণ হল যথেচ্ছ কর বৃদ্ধির ঘটনা। বস্তুত খাজনা বৃদ্ধির হার ছিল অত্যধিক, ১৭৯৩-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অর্থাৎ আশি বছর সময়কালে খাজনা বৃদ্ধি ঘটেছিল সাতগুণ। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনার কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।
অধ্যাপক কল্যাণকুমার সেনগুপ্ত পাবনার কৃষক বিদ্রোহের ওপর গবেষণা করে পাবনা ডিস্টার্বার্গ অ্যান্ড পলিটিক্স অব রেন্ট গ্রন্থে এই বিদ্রোহের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ইউসুফশাহি পরগনায় এই কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। পরগনাটি এক সময় নাটোররাজের অধীন ছিল, পরে কয়েকটি নতুন জমিদার পরিবার এই জমিদারি কিনে নেন। এখানকার নতুন জমিদার ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের দশ আইনকে অগ্রাহ্য করে নিজের খুশিমতো প্রজার দেয় খাজনা বাড়িয়ে যান। মূল ভূমিকরের সঙ্গে আবওয়াব যুক্ত করা হয়। অনেকসময় এই খাজনা বৃদ্ধির ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে যেত, সরকার ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা এসব পছন্দ করত না। জমিদাররা অন্যান্য অবৈধ পথেও তাদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল।
জমিদারদের অনেক অস্থায়ী ওঠবন্দি প্রজা ছিল, এদের জমিতে কোনো অধিকার ছিল না। সরকার প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করলে জমিদাররা এসব ওঠবন্দি প্রজা উচ্ছেদ করে বেশি খাজনায় নতুন প্রজা বসাতে থাকে। জমিদারের খাজনা বাড়ানোর অন্য কৌশল ছিল জরিপ ব্যবস্থা। জমিদারের আমলারা জমি জরিপ করে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি জমি বার করে নিয়ে নতুন করে বন্দোবস্ত করত। এসব ক্ষেত্রে ছোটো মাপকাঠি ব্যবহার করে প্রজাকে ঠকানো হত। সিরাজগঞ্জের মহকুমা শাসক নোলন (Nolon) এবং পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট টেলর উভয়ে মনে করেন অত্যধিক কর বৃদ্ধি হল পাকনা বিদ্রোহের প্রধান কারণ। সমকালীন সোমপ্রকাশ, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও সুলভ সমাচারে জমিদারি কর বৃদ্ধিকে পাবনা বিদ্রোহের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়। সোমপ্রকাশ লিখেছিল : ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারের দেয় কর চিরদিনের জন্য নির্ধারিত হইয়াছে, কিন্তু প্রজাদিগের দেয় করের সীমা নাই”।
অধ্যাপক কল্যাণ সেনগুপ্ত জমিদারি কর বৃদ্ধিকে পাবনা বিদ্রোহের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেননি। তাঁর মতে, পাবনা বিদ্রোহের প্রধান কারণ হল জমিদার দখলি রায়তের (occupancy ryot) অধিকার অস্বীকার করতে চেয়েছিল।
মূল্যায়ন
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের দশ আইন জমিদাররা মেনে নিতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম কমলে খাজনা কমাতে বলা হয়েছিল। এই আইন প্রজাদের যেসব অধিকার দিয়েছিল জমিদার তা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল, নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কৃষকদের মধ্যে এই চেতনা ও ঐক্যবোধ না থাকলে বিদ্রোহ হত না।
১৮৫৮-৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জমিদারের কর বৃদ্ধি তারা মেনে নিয়েছিল, তারা আশা করেছিল এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। তাদের প্রধান দাবি ছিল দুটি—দেয় করের স্থিতিশীলতা এবং তাদের অধিকারের স্বীকৃতি। জমিদার খুশিমতো প্রজা উচ্ছেদ করতে পারবে না। সরকারের কৃষক দরদি মনোভাব তাদের সাহস জুগিয়েছিল। সিরাজগঞ্জের মহকুমা শাসক মি. নোলনের হস্তক্ষেপের ফলে একজন অত্যাচারী জমিদারের শাস্তি হয়, এতে কৃষকদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .