পশ্চিমাবায়ু
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারা বছরধরে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত বায়ুকে পশ্চিমা বায়ু বলে। পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু প্রবাহকে পশ্চিমা বায়ু (Westerlies) বলা হয়।
■ [১] পশ্চিমাবায়ুর সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়গুলির সম্পর্ক
পশ্চিমাবায়ু উভয় গোলার্ধে সাধারণত ৩০° থেকে ৬০° অক্ষরেখার মধ্যে ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর ধরে প্রবাহিত হয়। ফেরেলসূত্র মেনে এই বায়ু উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু হিসেবে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাঁ দিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ু হিসেবে প্রবাহিত হতে থাকে।
■ [২] পশ্চিমা বায়ুর বৈশিষ্ট্য হল :
(১) পশ্চিমাবায়ু উত্তর গোলার্ধে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় (৩০° উত্তর অক্ষাংশ) থেকে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের (৬০° উত্তর অক্ষাংশ) দিকে প্রবাহিত হয় এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশ) থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের (৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশ) দিকে প্রবাহিত হয়।
(২) পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হওয়ায় এই বায়ুপ্রবাহকে পশ্চিমাবায়ু বলা হয়।
(৩) পশ্চিমাবায়ু উত্তর গোলার্ধে সরাসরি দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত না হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়।
(৪) পশ্চিমাবায়ু দক্ষিণ গোলার্ধে সরাসরি উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত না হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়।
(৫) উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি থাকার জন্য পাহাড় পর্বতে বাধা পায় বলে এই গোলার্ধে প্রবাহিত দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ুর গতিবেগ আয়নবায়ুর তুলনায় কিছুটা কম। অন্য দিকে পশ্চিমাবায়ুর গতিপথে এই গোলার্ধে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় হয়।
(৬) দক্ষিণ গোলার্ধ উত্তর গোলার্ধের তুলনায় জলভাগ বেশি থাকার জন্য এই গোলার্ধে প্রবাহিত উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ুর গতিবেগ উত্তর গোলার্ধে প্রবাহিত পশ্চিমাবায়ুর তুলনায় অনেক বেশি, তাই এই বায়ু প্রবল পশ্চিমাবায়ু নামেও পরিচিত।
(৭) দক্ষিণ গোলার্ধে স্থলভাগ খুব কম থাকায় উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ু ৪০° থেকে ৫০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে সারাবছর প্রবল বেগে এবং সশব্দে প্রায় সোজা পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়, এইজন্য দক্ষিণ গোলার্ধের ৪০° থেকে ৫০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী স্থানকে গর্জনশীল চল্লিশা (Roaring Forties) বলা হয়।
(৮) পৃথিবীর পরিক্রমণ গতির ফলে বায়ুচাপ বলয়গুলির উত্তর ও দক্ষিণে স্থান পরিবর্তনের ফলে উত্তর গোলার্ধের ৩০° থেকে ৪৫° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অংশে শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ু প্রবাহিত হয় আর গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে জুন) প্রবাহিত হয় উত্তর-পূর্ব পশ্চিমাবায়ু।
(৯) শীতকালে জলভাগের চেয়ে স্থলভাগ বেশি শীতল থাকায় পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে শীতকালে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে স্থলভাগ কম থাকার জন্য এই ধরনের বৃষ্টিপাত স্থলভাগের সামান্য অংশে (৩০°-৪০° দক্ষিণ অক্ষাংশে) সীমাবদ্ধ থাকে।
(১০) সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় পশ্চিমাবায়ু যথেষ্ট পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে বলে, পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পশ্চিম দিকে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার জন্য এই অঞ্চলে কৃষিকাজের সুযোগ সুবিধা বেশি। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও উৎপন্ন ফসলের উপর শীতকালীন পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই বেশি হয়।
(১১) পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্ব অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে যেতে থাকায় মহাদেশগুলির এই অঞ্চলের মধ্যবর্তী অংশে বিস্তীর্ণ নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি দেখতে পাওয়া যায়। এই তৃণভূমি উত্তর আমেরিকায় প্রেইরী, দক্ষিণ আমেরিকায় পম্পাস, রাশিয়া ও ইউরোপে স্টেপস্ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ডাউনস্ নামে পরিচিত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .